
সময়ের ব্যবধানে বদলে যাচ্ছে ছিনতাইয়ের কৌশল। নতুন নতুন কৌশল আর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে ছিনতাইয়ের শিকার হতে হচ্ছে পথচারী ও যাত্রীদের। ছিনতাইকারীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জখম হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুও হচ্ছে কারও কারও। গত ১১ মার্চ সমকালে ‘ওরা সালাম দিয়ে ছিনতাই করে!’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে ছিনতাইকারী চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির মিরপুর মডেল থানা পুলিশ। এ চক্রটি কোনো পথচারীকে দেখলে সালাম দেয়। পথচারী দাঁড়ালে তার সামনে গিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের ভয় দেখিয়ে টাকা-ফোন ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ জন্য তাদের ‘সালাম পার্টি’ বলেও চেনে অনেকে। অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টি– এ নাম দুটির সঙ্গে নগরবাসী পরিচিত হলেও সালাম পার্টির কথা অনেকের কাছেই নতুন মনে হতে পারে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ার চেষ্টা করে। এ ধাপে সফল হলে আপ্যায়নের প্রস্তাব দেয়। তখন খাবার বা পানির সঙ্গে অজ্ঞান করার ওষুধ মিশিয়ে দেয়। পরে টার্গেট ব্যক্তির টাকা-ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়। এ প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সহজ পথ খোঁজে ছিনতাইকারীরা। টার্গেট ব্যক্তির চোখে মলম লাগিয়ে দিয়ে ছিনতাই করে পালিয়ে যায় মলম পার্টির সদস্যরা। এ পার্টির চার সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের নামেই মামলা রয়েছে।
তবে, এর আগে, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করে গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁকফোকরে জামিনে বের হয়ে আবার পুরোনো অপরাধকর্মে সক্রিয় হতে দেখা গেছে এসব অপরাধীকে। অনেক সময় দুর্বল তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছে তারা । ছিনতাইকারী গ্রেপ্তারের পর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল ও অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব পুলিশ ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর। ব্যক্তির মামলার অপেক্ষায় না থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বাদী হয়ে মামলা করতে পারেন। অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর মামলা করার চেয়ে আগেই এসব ছিনতাইকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে আরও ভালো।
ঢাকা মহানগরীর ২ কোটি বাসিন্দার নিরাপত্তার জন্য ডিএমপির পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সদস্য রয়েছেন। এ ছাড়া এলিট ফোর্স র্যাবও পোশাকের পাশাপাশি সাদা পোশাকে তৎপর রয়েছে। এরপরও ছিনতাইকারী চক্র কৌশল বদলিয়ে অপরাধকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় কীভাবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল থাকার পরও এসব অপরাধ চলতে থাকলে দায়িত্বপ্রাপ্তদের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পথচারী বা যাত্রীকে অস্ত্রের মুখে ছিনতাই হওয়ার খবর আগের মতো ব্যাপক পাওয়া না গেলেও এটি বন্ধ হয়নি। বাস বা রিকশায় কথা বলা অবস্থায় মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়ই হচ্ছে। ইদানীং এ ছিনতাই কাজে মোটরসাইকেলের ব্যবহার হচ্ছে। লঞ্চে যাত্রীদের মালপত্র নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনা আগের মতো না হলেও ভোরে সদরঘাটে নামা নারী যাত্রীদের গলা ও কানের গহনা ছিনতাইয়ের ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। গহনা ছিনতাইকালে কান কেটে রক্তপাত হয় কারও কারও।
সালাম পার্টির মতো আরও যেসব চক্র সক্রিয় রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– ঝগড়া লাগানো বা ধাক্কা পার্টি। এ চক্রের সদস্যরা টার্গেট ব্যক্তির পায়ে পাড়া বা শরীরে ধাক্কা দেয়। এ নিয়ে ঝগড়া লাগানোর পর আশপাশে থাকা চক্রের অন্য সদস্যরা এসে ভয় দেখিয়ে টাকা-ফোন ছিনতাই করে নিয়ে যায়। নিজের ফোনে চার্জ বা ব্যালান্স না থাকার কথা বলে জরুরি ফোন করতে এক মিনিটের জন্য টার্গেট ব্যক্তির মোবাইল ফোনটি চান আরেক চক্র। পরে কথা বলতে বলতে পালিয়ে যায়। এসব ছিনতাইকারী তাদের নিরাপত্তার জন্য নির্জন স্থান বেছে নেয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মাঝে মধ্যে গ্রেপ্তার হতে দেখা যায় ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের। সংবাদমাধ্যমে সেই খবর ফলাও করে প্রচার হয়। কিন্তু নগরী ছিনতাইকারীমুক্ত হচ্ছে না। মাদকের মতো আইনে কঠোরতা আনার পাশাপাশি আইন প্রয়োগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্তরিক হলেই কেবল ছিনতাইকারীমুক্ত ঢাকা নগরী গড়ে তোলা সম্ভব।
মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com
মন্তব্য করুন