বাংলাদেশকে অঘটনের মুলুক বলা হলে হয়তো খুব একটা ভুল হবে না। এখানে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এমন ঘটনা ঘটে, যা দেখে মানুষের পিলে চমকে যায়। যেমন, দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার দাপটে সিংহভাগ মানুষের প্রাণ যখন প্রায় ওষ্ঠাগত, তখনই জানা যায়– কোটিপতি জন্মদানের হারে এ দেশ বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। বিশেষত করোনা-পরবর্তী সময়ে পুঁজির অভাবে যখন শত শত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ধুঁকছিল, তখনই খবর বের হলো, প্রায় অজ্ঞাত বিভিন্ন কোম্পানি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে গেছে। ওই অতিমারির সময়েই সাধারণ মানুষ যখন নিছক টেস্টিংয়ের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছিল, তখনই জানা গেল জালিয়াত সাহেদ ও সাবরিনার কথা, যাঁরা ভুয়া করোনা টেস্টিং সনদ পয়সার বিনিময়ে বিলিয়ে যাচ্ছেন, আবার তাঁদের মাথার ওপর ছিল সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আশীর্বাদের হাত। চাইলে এহেন পিলে চমকানো ঘটনার তালিকা আরও লম্বা করা যায়, যেখানে সর্বশেষ সংযোজন হতে পারে আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামের উত্থান।

সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত গত কয়েক দিনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী এ ব্যক্তি বয়সে প্রায় তরুণ হলেও ইতোমধ্যে পুলিশ খুন করে ফেরারি হিসেবে দেশান্তরী; এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে থিতু হয়ে এক প্রকার ধনকুবের হয়ে গেছেন।

তবে এসবের চেয়েও যে বিষয়টি মানুষকে চমকে দিয়েছে বেশি, তা হলো তাঁর এ দেশান্তরী ও সম্পদশালীর হওয়ার পেছনে নাকি প্রধান ভূমিকা ছিল ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তার। সহযোগী এক দৈনিক খবর দিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুনকে খুনের দায়ে যে মামলা হয়েছিল, তাতে রবিউল তথা আরাভ খানের নাম থাকলেও পরবর্তী সময়ে পুলিশেরই দেওয়া চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয় ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতা এবং পুলিশের তৎকালীন এক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের সুপারিশে। কী করে সম্ভব হলো সহকর্মী খুনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সহযোগিতা করা! আরও অবাক কাণ্ড, আরাভ খান নাকি ইতোমধ্যে ফেরারি অবস্থায়ই দুই দফা দেশে ঘুরেও গেছেন। কোনো আইন-আদালত তাঁর দিকে ফিরেও তাকায়নি।

সত্যিই আরাভ যদি দুবাইয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে তাঁর স্বর্ণের দোকান উদ্বাধনের আয়োজন না করতেন; আরও সঠিকভাবে বললে– দেশের ১ নম্বর ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানকে সে অনুষ্ঠানে নিয়ে না যেতেন, তাহলে খুনের আসামি হয়ে তাঁর এ মুক্ত জীবন নিয়ে কোনো হইচই হতোই না।

সাকিব হলেন বর্তমানে বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের তারকা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর যে কোনো তৎপরতা নিয়ে মানুষের আগ্রহ প্রবল। আর সেই ক্ষুধা মেটাতে সংবাদমাধ্যমও বলা যায় তাঁর পেছনে এক প্রকার সংযুক্ত। সংবাদমাধ্যমের এভাবে সাকিবের পিছু নেওয়ার কারণেই আরাভ খান পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এলেন। মানুষের নজর সাকিব বা দুবাইয়ের ওই অনুষ্ঠানে আরও যেসব বাংলাদেশি তারকা গেছেন, তাঁদের কাছ থেকে সরে এসে নিবদ্ধ হলো আরাভ খানের ওপর।

শুধু তাই নয়, পুলিশও এখন তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা চালাতে বাধ্য হচ্ছে। সোমবার সমকাল অনলাইনের এক প্রতিবেদন অনুসারে, খোদ পুলিশ মহাপরিদর্শক জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ইন্টারপোলকে তাঁরা আরাভ খানের বিষয়ে এক লাল নোটিশের মাধ্যমে অবহিত করেছেন এবং ইন্টারপোলও সে নোটিশ গ্রহণ করেছে। ধারণা করা যায়, সংবাদমাধ্যমের ধারাবাহিক নজরদারির কারণে আরাভ খানকে দেশে এনে আইনের মুখোমুখি করার জন্য পুলিশ আর ঢিলেমি করবে না। অর্থাৎ আরাভ অধ্যায়ের এইভাবে যবনিকাপাত হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা একটি দরিদ্র ছেলের এহেন চমক লাগানো উত্থানের পেছনে যে বা যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাঁদের চেহারা কি মানুষ দিনের আলোয় দেখতে পাবে? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলেই শুধু নতুন কোনো আরাভের উত্থান বন্ধ করা যাবে।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল