
রহমত, মাগফেরাত ও নাজাত– এ তিনের সমন্বয়ে পবিত্র মাহে রমজান। মাহে রমজান ও তাকওয়ার মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। কেননা, রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদারকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হয়। তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের রোজা পালন ফরজ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা আল-বাকারার ১৮৩ আয়াতে এরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’
আরবি ‘তাকওয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আল্লাহভীতি, পরহেজগারি, দ্বীনদারি, ভয় করা, বিরত থাকা, আত্মশুদ্ধি, নিজেকে কোনো বিপদ-আপদ বা অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা প্রভৃতি।
ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার, পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী মানবজীবন পরিচালনা করার নামই তাকওয়া।
তাকওয়া মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ইহকালীন জীবনে শান্তি ও পরকালীন জীবনে মুক্তির মূল ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন। তাই রমজান মাসে তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।
ইবাদত-বন্দেগির মূল উদ্দেশ্য অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করা। আল্লাহতায়ালা সুরা হজের ৩৭ আয়াতে এরশাদ করেন– আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত ও রক্ত; বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।
কোনো মুসলমান যদি পবিত্র কোরআন ও রাসুলে পাক (সা.)-এর সুন্নাহকে সঠিকভাবে বুঝে আমল করতে পারে, তাহলে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ তার অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করবে।
আল্লাহতায়ালা সুরা জুমার ২৭-২৮ আয়াতে এরশাদ করেন– নিশ্চয় আমি এ কোরআনে মানুষের জন্য সব দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে। বক্রতামুক্ত আরবি কোরআন, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে।
আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। আল্লাহতায়ালা সুরা ইউনুসের ৬ আয়াতে এরশাদ করেন– নিশ্চয় রাত ও দিবসের বিবর্তন এবং আসমান ও জমিনে যা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তাতে বহু নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে।
হাদিসে বর্ণিত, একদা কোনো এক ব্যক্তি তাকওয়ার অর্থ জিজ্ঞেস করলে হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘আপনি কি কখনও কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন?’ বললেন, ‘হ্যাঁ।’ ‘আপনি তখন কী কী করেছিলেন?’ ‘আমি সাবধানতা অবলম্বন করে দ্রুতগতিতে ওই পথ অতিক্রম করেছিলাম।’ বলা হচ্ছে, এটাই তাকওয়া। এভাবে সাবধানী পথ চলাই তাকওয়া। আর তাকওয়াসম্পন্ন ব্যক্তিকে মুত্তাকি বলে।
মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহির অনুভূতিকে তাকওয়া বলে। হাদিস শরিফের আলোকে তাকওয়ার সংজ্ঞা হলো, রাসুলে পাক (সা.) যা করতে বলেছেন তা করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা। ইমান-আকিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব বৈরী পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে স্বীয় মহৎ বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে জীবনযাপন করার নামই তাকওয়া। তাই কোনো রোজাদার মুমিন মুত্তাকি ব্যক্তি কখনও কাউকে তিরস্কার, অবজ্ঞা, দাম্ভিকতা, গর্ব-অহংকার, কটূক্তি, কুৎসা রটনা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা তুচ্ছজ্ঞান করতে পারে না। সে কখনও দুরাচার, কদাচার, দুশ্চরিত্র, দুষ্কর্ম ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে পারে না।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা আল-হুজুরাতের ১৩ আয়াতে এরশাদ করেন– ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকি।’
মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি শিরক, কবিরা গুনাহ, অশ্লীল কাজকর্ম এবং কথাবার্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখে, তাকে মুত্তাকি বলা হয়।
যিনি মুত্তাকি বা পরহেজগার হবেন, তিনি যাবতীয় অন্যায় ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবেন এবং ভালো কাজের অনুশীলন করবেন।
সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারি, বিশ্বস্ততা, ধৈর্য, ন্যায়বিচার বা আদল, ইহসান– যত রকম মানবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তিনি সেগুলোর অধিকারী হতে চেষ্টা করবেন। তিনি সর্বদা সৎ কাজ করবেন এবং অপরকে সৎ কাজের প্রতি বিনীতভাবে আহ্বান জানাবেন। সেই সঙ্গে নিজে অসৎ কাজ থেকে সর্বদা বিরত থাকবেন এবং অন্য সবাইকে অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে সচেষ্ট হবেন। তিনি সময়মতো নামাজ আদায় করবেন, জাকাত প্রদান করবেন এবং মাহে রমজানে সিয়াম সাধনা তথা রোজাব্রত পালন করবেন।
মাহে রমজানে সিয়ামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে তাকওয়া ও হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাকওয়া হচ্ছে হৃদয়ের এক বিশেষ অবস্থার নাম। তাকওয়া হলো আল্লাহর বিধিবিধান পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে না পারলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা অসম্ভব।
সিয়ামের সঙ্গে রয়েছে তাকওয়ার নিবিড় যোগসূত্র। সিয়াম মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টি করে। ফলে পরিবার ও সমাজজীবনে মানুষ যাবতীয় অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে এবং সৎ কাজ করার জন্য অগ্রসর হতে পারে।
তাকওয়ার মাধ্যমেই বান্দা ইহকাল ও পরকালে তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। তাকওয়ার গুণাবলি অর্জিত হওয়ার পর রোজাদার মুমিনের হৃদয় আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। এমনিভাবে রমজান মাসে তাকওয়াভিত্তিক চরিত্র গঠনে রোজাদার ব্যক্তি আন্তরিক ও নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
বিষয় : ইসলাম ও সমাজ মো. শাহজাহান কবীর
মন্তব্য করুন