আমাদের সময়ের অন্যতম ভাস্কর শামীম। ৬৮ বছর বয়সে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বিদেশে ছিলেন অনেক দিন; অসুস্থও ছিলেন। সম্প্রতি দেশে এসেছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর ভাস্কর্যগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছেন। লোকজন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায়ও প্রবল মানসিক শক্তির জোরে নিজেকে চালিত রেখেছিলেন। 

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে এক দিন আর্ট এজেন্সি আর্টকনের ফাউন্ডার এআরকে রিপনের তাগিদে আমার কাজ দেখতে এসেছিলেন শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলার বারান্দায় আমাকে কাজ করতে দেখে আস্তে করে বললেন, ‘সারাজীবনই রাসা এই বারান্দা­-ওই বারান্দায় কাজ করে গেল। নিজের একটা স্টুডিও করতে পারল না। এই হয় এ দেশে!’

ভাস্কর শামীম একজন সাহসী ও দেশপ্রেমিক। সব সময় কাজ করতে ভালোবাসতেন। অনেক কাজ রয়েছে তাঁর ৬৮ বছরের জীবনে। করেছেন প্রতিকৃতি, গুণীজনের প্রতিকৃতি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিউবিক ফর্মের কাজটি সুন্দর। স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শহীদ নূর হোসেনের ভাস্কর্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতলের প্রতিকৃতি করেছেন। ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’র মতো বিশাল আকৃতির গুচ্ছ ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। আরও আছে স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য। এ কাজ করতে গিয়ে একাধিকবার আহত হয়েছেন।

আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু শামীম স্পষ্টবাদী ও নির্ভীক ছিলেন। তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ চলাফেরা থেকে বোঝা যেত, তিনি ভিন্নধর্মী। আমার খোদাই করা ভাস্কর্য বিষয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর। কাজের সময় দেখেছি, অতি মনোযোগী থাকতেন। এক সময় তাঁর মডেল ছিলেন ‘দাদু’ নামে এক বিনয়ী বৃদ্ধ।

মডেল পাওয়া সেই সময়ে বেশ কষ্টসাধ্য। অবশ্য মাঝেমধ্যে তাঁকে ভীষণ রাগান্বিত দেখেছি। প্রথাবিরোধী এক ধরনের শিল্প-চেতনা তাঁর অন্তরকে দোলায়িত করত। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিশাল ভাস্কর্যটি চারুকলায় স্থায়ী বেজে রাখা আছে। এই ভাস্কর্যটি শামীম অনেক দিন ধরে করেছেন। দীর্ঘদিন শিল্পাচার্যের ভাস্কর্যটি উন্মুক্ত ছিল। অনেকে ছবি তুলত। কয়েক বছর  ধরে ভাস্কর্যটির মুখাবয়ব পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল চারুকলা কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ– ছবির সঙ্গে ভাস্কর্যটি মিলছে না, তাই কর্তৃপক্ষ ঢেকে দিয়েছে। ছবি দ্বিমাত্রিক আর ভাস্কর্য ত্রিমাত্রিক। তাই হুবহু ছবির মতো হয় কীভাবে? আর অবিকল নকল তো হচ্ছে কপি করা। এই কাজটি শামীম করেননি। শান্তিনিকেতনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ ভাস্কর্যটি করেছেন জগৎখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ। ছবির সঙ্গে সেই ভাস্কর্যকে মিলিয়ে দেখলে কী মনে হয়? কবির জীবদ্দশায় সৃজন করেছেন রামকিঙ্কর; এখন পর্যন্ত তো কেউ প্রশ্ন তোলেননি– এটি বিশ্বকবির ভাস্কর্য হয়নি। যা হোক, জীবদ্দশায় শামীম তাঁর প্রিয় ভাস্কর্যটি দেখলেন– ঢেকে রাখা। এ বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি দেখলেন না, তাঁর ভাস্কর্যটি অবশেষে উন্মুক্ত। দেখল তাঁর লাশ বহনকারী কফিনটি। এই হচ্ছে তথাকথিত ভাস্কর ও ভাস্কর্যবোদ্ধাদের মানসিক দৈন্য। সময় হচ্ছে সবচেয়ে বড় পরীক্ষক। সে কাকে নেবে আর কাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে, আমরা জানি না। বিদ্রোহী, প্রতিবাদী ব্যক্তিদের প্রতি ছিল শামীমের অশেষ সম্মান।

ভাস্কর শামীম সিকদার

ভাস্কর শামীম সিকদারের শিল্পকর্মের সংখ্যা অনেক। প্রধানত তিনি সিমেন্ট, রড, বালু, সাদা সিমেন্ট ব্যবহার করতেন শিল্পকর্ম গড়ার ক্ষেত্রে। তবে কাঠ খোদাই করে সৃজন করেছেন অল্প কয়েকটি শিল্পকর্ম। তাঁর মডেল দাদুর একটি আবক্ষ খোদাই ভাস্কর্য দেখেছি ১৯তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে আমন্ত্রিত শিল্পীদের গ্যালারিতে। বেশ কয়েকটি শিল্পকর্ম করেছিলেন স্টিলের তৈজসপত্র দিয়ে। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা শিল্পকর্মটি গুচ্ছ ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে তিনি গড়েছেন এই ভাস্কর্য– পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে; পাশাপাশি টগবগে তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্টেনগানে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাচ্ছে; চারদিকে হাই রিলিফ ফর্মে সৃজন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। এসেছে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমি। কিউবিক ফর্মে ভাস্কর্য সম্ভবত বাংলাদেশে একটি হয়েছে এবং এই কাজটি করেছেন ভাস্কর শামীম শিকদার। এই কাজটি আছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সবুজ চত্বরে। বিশাল আকৃতির ভাস্কর্য নির্মাণের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল তীব্র। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্যটি এর দৃষ্টান্ত। পূর্ণ অবয়বে কবির বিশাল শরীর। সুসজ্জিত পরিপাটি পোশাকে কবি বিশাল কামানের পাশে; হাত রেখেছেন কামানের গায়ে। অথবা কবি কামানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কামানের আকৃতিটি এক সময় গুলিস্তানের মোড়ে রাখা মীর জুমলার কামানের মতো। সাবলীল অবয়বে কবি তাকিয়ে আছেন সম্মুখপানে। এই শিল্পকর্মটিতে ভাস্কর নান্দনিক ছোঁয়া একটু বেশিই দিয়েছেন বলে আমার ধারণা। একই সঙ্গে উচ্চতাও অর্জন করেছে ভাস্কর্যটি।

ভাস্কর শামীম সিকদারের সব শিল্পকর্মের একটি তালিকা হওয়া জরুরি। একই সঙ্গে একটি দ্বিভাষিক অ্যালবাম বা ব্রুশিয়ার করা দরকার, যা আগামী প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন। উল্লিখিত কাজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যৌথভাবেও করতে পারে।

ভাস্কর নভেরা আহমেদ শুরু করেছিলেন বাংলাদেশে ভাস্কর্যচর্চা, আর ভাস্কর শামীম সিকদার তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে আরও এগিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের ভাস্কর্যচর্চা। নির্ভীক, সাহসী, প্রতিবাদী ও স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন তিনি। সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় অন্ধত্ব, শিক্ষার হার ইত্যাদি মিলিয়ে রোগাক্রান্ত এই সমাজে ভাস্কর শামীম সিকদার আলোকচ্ছটা হয়ে এসেছিলেন আমাদের মাঝে।

ভাস্কর রাসা: ভাস্কর্য শিল্পী