
আমাদের বিক্রমপুরের প্রবাদ- ‘ধোয়ার চেয়ে অধোয়া ভালো, ধুইতে ধুইতে সবই গেল!’ দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতে শুদ্ধি অভিযানের নামে যে কাণ্ডকারখানা চলছে, তা দেখে উপরোক্ত প্রবাদ মনে এলো।
বিএনপির শুদ্ধি অভিযানের সর্বশেষ শিকার হয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদ। বহিষ্কারের চিঠিতে তাঁকে কী বলা হয়েছে, তা জানা না গেলেও দলটির পক্ষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে লিপ্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জনাব শওকত মাহমুদকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’ তবে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কী ধরনের কাজে তিনি লিপ্ত ছিলেন, তা বলা হয়নি।
গত বুধবার সমকালে ‘পর্দার আড়ালে ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে দলের একাধিক সূত্র বলেছে, শওকত মাহমুদ সরকারের সঙ্গে পর্দার অন্তরালে যোগাযোগ করছিলেন। অন্যদিকে শওকত মাহমুদ বলেছেন, সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে সপ্তাহে চার দিন আদালতে যেতে হতো না।
বস্তুত বেশ কিছুদিন ধরেই শওকত মাহমুদের বিভিন্ন তৎপরতাকে দলের একটি অংশ সন্দেহের চোখে দেখছিল। সে অংশটি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। শওকত মাহমুদের সর্বশেষ ‘অপরাধ’– ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস’ এবং ‘জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’ নামের অরাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা; যেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ছাড়াও নাগরিক সমাজের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। সংগঠনটি একটি প্রস্তাবনাও উপস্থাপন করেছে।
এক বন্ধুর বদান্যতায় প্রস্তাবনাটি আমার হস্তগত হয়েছে। সেটার কোথাও বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো বক্তব্য পাইনি। বরং সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশে মুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে জনমত সংগঠিত করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়েছে। তাহলে সেটা বিএনপিবিরোধী কর্মকাণ্ড হলো কী করে?
ফোনে শওকত ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম– এমন কী দোষ করেছিলেন যে, আপনাকে দল থেকে বিতাড়িত করা হলো? তিনি বললেন, ‘কী আর করব ভাই! এখানে শাস্তি পেতে কোনো দোষ করা লাগে না।’ বিমর্ষ শওকত ভাইয়ের সঙ্গে আর কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম, এরা যা শুরু করেছে, তাতে দলের অবস্থা শেষ পর্যন্ত ‘হারাধনের দশটি ছেলে’র মতো হয় কিনা, কে জানে!
শওকত মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘদিনের। আজীবন জাতীয়তাবাদী আদর্শের পক্ষে কাজ করেছেন। তা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। দেশের সাংবাদিক সমাজের মধ্যে গ্রহণযোগ্য যে ক’জন নেতা বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, শওকত মাহমুদ নিঃসন্দেহে সে তালিকার শীর্ষ পর্যায়ের। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের দু’বার সাধারণ সম্পাদক ও দু’বার সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশেরও সভাপতি ছিলেন। দেশ-বিদেশে তাঁর একটি পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু বিএনপির কাছে ওসবের যে কানাকড়ি মূল্য নেই– সর্বশেষ ঘটনায় তা প্রমাণিত।
একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে ভিন্নমত থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। শওকত মাহমুদের দোষ, তিনি কোনো কোনো বিষয়ে দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতেন। বিএনপি নিজেদের গণতান্ত্রিক দল বলে দাবি করে। কিন্তু বর্তমানে দলটির গণতান্ত্রিক চরিত্র কতটুকু অক্ষুণ্ন– তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ‘জান কোরবান’ আন্দোলনের ‘কসম’ খেয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিকতার অভিযোগ করে। কিন্তু তাদের দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র আছে কিনা– সে প্রশ্নে নিরুত্তর।
বুধবার একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ‘শওকত মাহমুদের পরে কে’ শীর্ষক কলামে লিখেছেন, ‘একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, ম্যাডামের সামনে কথা বলা যেত; তর্কাতর্কিও করা যেত। কিন্তু তারেক রহমানের সামনে কথা বলা যায় না। সবাইকে বিনা প্রশ্নে তাঁর কথা মানতে হবে; নির্দেশ পালন করতে হবে। তারেক নিজের মতো করে দল গোছাতে গিয়ে দলের ভেতরে অনৈক্যের বীজ বপন করেছেন।’ মন্তব্যটি নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কেননা, এর আগেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন কথিত তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনার নামে দলের প্রবীণ, প্রজ্ঞাবান এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এর ফলে দলটি অচিরেই নেতৃত্বশূন্যতায় পড়তে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতাও কম তিক্ত নয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রায় ৩৮ বছর এই দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে শেষ পর্যন্ত বিদায় জানাতে হয়েছে। তৃণমূল কর্মী থেকে বহু পথ পরিক্রমণ এবং ত্যাগ স্বীকার করে উঠে এসেছিলাম কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। কিন্তু সেখান থেকে আমাকে ছিটকে পড়তে হয়েছে। চিহ্নিত একটি চক্র এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যে, টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। নিজে পদত্যাগ না করলে আমাকেও হয়তো শওকত মাহমুদের ভাগ্য বরণ করতে হতো। চক্রটি সবসময় সক্রিয়। এদের কাজই হলো শীর্ষ নেতৃত্বের কান ভারি করে অপছন্দের নেতাদের ধরাশায়ী করা।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, শীর্ষ নেতৃত্ব মোসাহেবদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে সত্যাসত্য যাচাই না করেই পরোয়ানা জারি করে দেন। সে রকম পরোয়ানারই আপাত সর্বশেষ শিকার হলেন শওকত মাহমুদ। বহিষ্কারের আগে সাধারণত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় অভিযুক্তকে। কিন্তু শওকত মাহমুদকে তা দেওয়া হয়নি। বছর দুয়েক আগে একবার তাঁকে শোকজ করা হয়েছিল। তিনি তাঁর জবাবও দিয়েছিলেন। সেবার দলটির হাইকমান্ড তাতে ‘সন্তুষ্ট’ হয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু এবার আর তা করা হয়নি। সরাসরি বহিষ্কার। খারাপ লাগছে শওকত ভাইয়ের জন্য। সাংবাদিকতা জীবনের সব অর্জনকে এক পাশে সরিয়ে রেখে যে দলের পক্ষে কাজ করতে এলেন; সে দল তাঁকে এক লহমায় ছুড়ে ফেলে দিল!
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শওকত মাহমুদের কর্মকাণ্ড সন্দেহজনক ছিল। শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কাউকে ‘গিলোটিনে’ দেওয়া কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত– সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কথায় আছে, ‘সন্দেহ যদি দরজা দিয়ে ঢোকে, বিশ্বাস তখন জানালা দিয়ে পালায়।’ বিএনপি কি সে রোগে আক্রান্ত?
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন