- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- তিস্তায় ‘দুই’ খালের আড়ালে তিন সর্বনাশ
সমকালীন প্রসঙ্গ
তিস্তায় ‘দুই’ খালের আড়ালে তিন সর্বনাশ

প্রকৃতপক্ষে তিন খাল; দুটি নয়। শুধু খাল নয়; খালের আড়ালে উজানের অংশে আরও তিন সর্বনাশ ঘনিয়ে উঠছে বহুল আলোচিত আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তাকে কেন্দ্র করে। ভাটিতে বসে আমরা যখন দৃশ্যত ও কার্যত শুধু খাল দিয়ে তিস্তার পানি অপসারণের শঙ্কা ব্যক্ত করছি, তখন উত্তরাঞ্চলের আরেকটি প্রধান নদী ধরলার পানিও একই খাল দিয়ে অপসারণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত। একই সঙ্গে তিস্তা, ধরলা ও মহানন্দার উপনদীগুলোতে এক ডজনের বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিস্তায় দুই খালের আড়ালে আসলে চলছে তিন সর্বনাশের তোড়জোড়।
প্রথম সর্বনাশ অবশ্যই নতুন করে খনন হতে যাওয়া খালগুলো। গজলডোবা ব্যারাজ প্রকল্প থেকে যে আরও দুটি খাল খনন করে পানি সরানোর উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার– সেই খবর দিয়েছিল ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা। এই লক্ষ্যে ৩ মার্চ ২০২৩ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রাজ্য সেচ বিভাগের কাছে এক হাজার একর জমি হস্তান্তর করে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন। যদিও ‘দুই খাল খনন’ সংক্রান্ত খবরটি সীমান্তের দুই পাশে ছড়িয়ে পড়তে আরও সপ্তাহখানেক লেগেছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় খালের খবরটি আড়ালেই পড়ে যায়।
আলোচ্য দুই খালই খনন করা হবে তিস্তার বাম তীরে, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায়। এর মধ্যে ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল গজলডোবা ব্যারাজ থেকে কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত যাবে। দ্বিতীয় খালটি জলপাইগুড়ি জেলাতেই থাকবে; দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার। তৃতীয় আরেকটি খাল ১৯৮৭ সালে প্রকল্পটি উদ্বোধনের সময়েই জলপাইগুড়ির ধুপগুড়ি ব্লক এলাকায় খনন করা হয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি চালু করা হয়নি। কালক্রমে অনেক জায়গায় বুজেও গেছে। এখন সেই খালও খনন করা হবে। এর প্রকৃত দৈর্ঘ্য এখনও স্পষ্ট নয়।
গজলডোবা ব্যারাজ প্রকল্পের প্রধান খালগুলো নদীর দুই পাশে দুই ভাগে বিভক্ত। ডান তীরের প্রধান ও শাখা খালগুলোর দাপ্তরিক নাম ‘টিএমএলসি’ তথা তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খাল এবং বাম তীরের প্রধান ও শাখা খালগুলোর দাপ্তরিক নাম ‘টিজেএলসি’– তিস্তা-জলঢাকা সংযোগ খাল। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, এত দিন শুধু ডান তীরের খালগুলোই চালু ছিল; তিস্তার পানি মহানন্দা হয়ে ডাহুক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কিন্তু বাম তীরের খালগুলোর খননকাজ কার্যত শুরুই হয়নি। পাশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এবার সেদিকে নজর দিয়েছে।
জমি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। তিনি বলেছেন, ‘২০০৯ সালেই কেন্দ্রীয় সরকার এটাকে (টিজেএলসি খাল খনন) জাতীয় প্রকল্প ঘোষণা করেছিল। কিন্তু কোনো অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছিল না। যদি বরাদ্দ নাও মেলে, নিজেদের অর্থেই পর্যায়ক্রমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করব আমরা।’ (দ্য টেলিগ্রাফ, ৪ মার্চ, ২০২৩)।
এসব খাল খননের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই তিস্তা থেকে ভারতে পানি অপসারণের মাত্রা ও পরিমাণ আরও বাড়বে। গজলডোবা ব্যারাজ নির্মিত হওয়ার আগে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে শুকনো মৌসুমে পানি প্রবাহ ছিল ৬ থেকে ৭ হাজার কিউসেক। ব্যারাজ নির্মাণের পর সেটা গড়ে ১২ থেকে ১৫শ কিউসেকে নেমে আসে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে ৫শ কিউসেকেরও নিচে নেমে এসেছে পানি প্রবাহ। তিন খাল খননের পর পর সেটুকুও পাওয়া যাবে কিনা, সন্দেহ।
দ্বিতীয় সর্বনাশের পথরেখা লুকিয়ে আছে মূল নকশায় প্রধান খালটির ‘টিজেএলসি’– তিস্তা-জলঢাকা সংযোগ নামের মধ্যেই। শুধু তিস্তা নয়; ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটির মাধ্যমে জলঢাকা নদীর পানিও সেচকাজের জন্য প্রত্যাহার করা হবে। তার মানে, এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো এক খালে দুই নদীর সর্বনাশ করতে যাচ্ছে উজানের প্রতিবেশী।
অনেকের মনে থাকার কথা, ২০১৫ সালের এপ্রিলে ভারত সফরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন প্রায় শেষ মুহূর্তে, মূলত সফরকারী অতিথির আগ্রহেই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানকার রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শেখ হাসিনা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি তুললে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিস্তায় ভাগাভাগির মতো পানি অবশিষ্ট নেই। তার বদলে বরং তোরষা ও জলঢাকা নদীর পানি বণ্টন করা যেতে পারে। তখনই আমি লিখেছিলাম, এটা আসলে শুভঙ্করের ফাঁকি। কারণ তোরষা ও জলঢাকা আসলে বাংলাদেশের দুধকুমার ও ধরলা নদী। ওই দুই আন্তঃসীমান্ত নদীতেও আমাদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। অপর আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তার বিনিময়ে ওই দুই নদীতে নতুন করে অধিকার প্রতিষ্ঠার কিছু নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, তিস্তার হিস্যা দূরে থাক, জলঢাকার পানিও নিয়ে যেতে চাইছে ভারত!
তৃতীয় সর্বনাশ হচ্ছে, তিস্তা ও মহানন্দার উজানে দার্জিলিং জেলার বিভিন্ন এলাকায় তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতীয় পত্রপত্রিকাই খবর দিচ্ছে, তিস্তায় অন্তত দুটি মাঝারি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এখন ডিপিআর-বিস্তারিত প্রকল্প প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে। প্রকল্প দুটির নাম তিস্তা লো ড্যাম প্রজেক্ট বা টিএলডিপি– এক ও দুই। আমরা বাংলাদেশে যে নদীকে তিস্তা নামে চিনি, সিকিমে সেটা রঞ্জু ও রঞ্জিত নামে দুই ধারার মিলনে সৃষ্ট। ডানদিক থেকে রঞ্জিত এবং বামদিক থেকে রঞ্জু সিকিম-বেঙ্গল সীমান্তরেখা তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের আগে মিলিত হয়ে তিস্তা তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার চাইছে ওই রঞ্জিত নদীতে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৭১ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে।
এখানেই শেষ নয়; আরেকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যও নীতিগত সিদ্ধান্ত ও ডিপিআর তৈরির নির্দেশনা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। ৩৮ মেগাওয়াট জলবিদ্যুতের এই প্রকল্পের নাম বালাসন হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট বিএইচপি। প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও খরস্রোতা বালাসন নদী মহানন্দার ডান তীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ। দার্জিলিংয়ের জোড়পাখরি পার্বত্যাঞ্চলে উৎপন্ন হয়ে শিলিগুড়ি শহরের কাছে মহানন্দায় মিশেছে। আরও উজানে আরেকটি পার্বত্য নদী রঙভঙ মিশেছে বালাসনের সঙ্গে। এ দুই নদীর মিলনস্থলের কাছে নির্মিত হবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এ ছাড়া দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন পার্বত্য প্রবাহে আরও ১০টি ক্ষুদ্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিকল্পনা নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর অর্থ, তিস্তা ও মহানন্দায় পানিপ্রবাহ আরও কমে যাবে।
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে কীভাবে ভাটির দেশে প্রবাহ কম ও সিল্টেশন বা তলানিপ্রবাহ বৃদ্ধি হয়, তা নিয়ে স্বতন্ত্র নিবন্ধ লিখতে হবে। এখনকার কথা হচ্ছে– নতুন খাল, জলঢাকা নদীর পানি প্রত্যাহার ও ডজনখানেক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প– পশ্চিমবঙ্গের তিন ধরনের প্রকল্পেই সর্বনাশ হবে বাংলাদেশের।
এদিকে ঢাকার পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষে নতুন দুটি খাল খনন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে নয়াদিল্লিকে কূটনৈতিক চিঠি বা ‘নোট ভারবাল’ পাঠানো হয়েছে। (সমকাল, ২০ মার্চ, ২০২৩)। আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, সেই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেছেন– ‘আমরা এটার ওপর কমেন্ট করব না। আমরা যেটা করতে চাচ্ছি যে, আমরা একটা চিঠি তাদেরকে দিচ্ছি। সেই চিঠিটার উত্তর এলে পরে আমরা বুঝতে পারব, সত্যি তারা ডাইভার্টি করতেছে কি, করতেছে না।’ (বিডিনিউজ, ১৬ মার্চ, ২০২৩)।
বলা বাহুল্য, জলঢাকা তথা ধরলার পানি প্রত্যাহারের আশঙ্কা কিংবা তিস্তা ও মহানন্দার উপনদীগুলোতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে উদ্বেগ জানানোর বিষয়টি সম্ভবত আরও দূরের বিষয়।
শেখ রোকন: সহযোগী সম্পাদক, সমকাল; মহাসচিব, রিভারাইন পিপল
skrokon@gmail.com
মন্তব্য করুন