সংবাদমাধ্যমের আজকের বাস্তবতা ’৭১-এ ছিল না। ছিল না এখনকার মতো খবরের তাৎক্ষণিকতা। ঘটনা ঘটামাত্র ব্রেকিং নিউজ তো নয়ই; আজকের খবর আজকে জানাও ছিল ধারণার বাইরে। ঘটনার পরদিন বা আরও এক দিন অপেক্ষা করতে হতো। স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা রাখা পত্রিকাগুলোর কয়েকটিতেও ২৫ মার্চ রাতে হামলা হয়। মানে পরদিন এগুলো প্রকাশিত হয়নি। বাকি কয়েকটি ভয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। একাত্তরের ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা বা ক্র্যাকডাউন অথবা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা তাহলে কীভাবে জানল দেশবাসী ও বিশ্ববাসী?

বেশিরভাগ মানুষের ২৫-২৬ মার্চ রাতের খবর জানা হয়েছে আরও পরে; বিদেশি গণমাধ্যম থেকে। ২৫ মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ২৭ মার্চে প্রচারিত হয় বিদেশি ২৫টির মতো পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থায়। ভারতের কয়েকটি সংবাদপত্র, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরের স্থানীয় খবরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকে মূল বিষয় করা হয়। বিস্তারিত খবর প্রকাশে আরও সময় লেগে যায়, যা আজকের বাস্তবতায় অকল্পনীয়।

তখন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরের সোর্স ছিল ভারত। তাদের বরাত দিয়ে বিবিসি পরিবেশিত সংবাদ ছিল এ রকম– ‘...কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ করা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গোপন বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।’ আর ভয়েস অব আমেরিকারটি এমন–...‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারাবিশ্বের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।’

দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর খবর– ‘...বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’

দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন ২৭ মার্চের পত্রিকার শিরোনাম ছিল বেশ বড়– ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইজ প্রেসিডেন্ট’। এতে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খানের ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলার কথা উল্লেখ করা হয়।


ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার খবর– ‘২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।’ আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ডের ২৭ মার্চের সংখ্যার  শিরোনাম– ‘বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।’ নিউইয়র্ক টাইমসে শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়ার পাশাপাশি ছবি দিয়ে শিরোনাম করা হয়– ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।’ বার্তা সংস্থা এপির খবর– ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।’ ব্যাংকক পোস্টের খবরে বলা হয়– ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

পরের মাস এপ্রিলের ১৮ তারিখে লন্ডনের দ্য অবজারভারে আসে ২৫-২৬ মার্চের ঘটনাসহ বিস্তারিত সংবাদ। তাতে ‘স্বপ্নভঙ্গের পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের সংবাদে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে, ছাত্রহত্যা এবং লেখক ও সাংবাদিক হত্যার খবর ছাপা হয়। এর আগে ১২ এপ্রিল নিউজউইক সংবাদ ছাপে ‘একটি আদর্শের মৃত্যু’ শিরোনামে। এর পর একে একে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নিউজ আইটেম হতে থাকে ২৫ মার্চের ঘটনা; পূর্ববাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের খবর।

খবর জমতে থাকে মে-জুনে গিয়ে। ১৩ জুন দ্য সানডে টাইমসে মাত্র এক শব্দে ‘গণহত্যা’ শিরোনামে ১৪ পৃষ্ঠার রিপোর্ট; লেখক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের নয়াদিল্লি থেকে ‘দ্য  উইকলি নিউ এজ’ পত্রিকা শিরোনাম করে– ‘বিজয় নিশ্চিত’।

২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে জানানোসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে বিদেশি গণমাধ্যমের সেই ভূমিকা আমাদের ইতিহাসের একটি বড় অংশ। তাদের সেদিন ওই পেশাগত ভূমিকা না থাকলে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, বর্বরতা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ববাসীর জানার বাইরে থেকে যেতে পারত।

যুদ্ধের সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংবাদ প্রচারে বিবিসি, টেলিগ্রাফ, নিউজউইক, অবজারভারসহ অনেক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বেশ ক’জন মার্চের শুরু বা আরও আগে থেকেই পূর্ববাংলার দিকে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আসতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তাঁদের আগ্রহ আরও বাড়তে থাকে। সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আঁচ করে প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপানসহ কয়েকটি দেশের প্রায় ৩৭ জন সাংবাদিক একসঙ্গে উঠেছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৫ মার্চ কালরাতের  আগে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বিদেশি ওই সাংবাদিকদের হোটেলটিতে এক প্রকার অবরুদ্ধ করে রাখে। মাঝরাতে গোলাগুলি শুরু হলে তাঁদের কয়েকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে যান সংবাদ সংগ্রহ করতে। পাকিস্তান সরকারের আজ্ঞাবহ প্রশাসন দেরি না করে পরদিনই তাঁদের বিদেশগামী প্লেনে তুলে ঢাকাছাড়া করে। এ সংবাদ ২৬ মার্চ কলকাতার আকাশবাণী, বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে। এর মধ্য দিয়ে প্রচার হয়ে যায় গণহত্যার কিছু বিবরণও। 

অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘জেনোসাইড’ শিরোনামের দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়েই নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় সিডনি শনবার্গের প্রতিবেদন। যুদ্ধের শুরুতে এদেশ থেকে বহিষ্কৃত হলেও বারবার তিনি ফিরে এসেছেন। সীমান্তের শরণার্থী শিবির ও মুক্তাঞ্চলে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। টাইম, নিউজউইক, দ্য অবজারভার, ডেট্রয়েট ফ্রি প্রেস, দ্য স্পেকটেটর, আকাশবাণী, উইকলি নিউ এজসহ বিদেশি অনেক পত্রিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংবাদ নিয়মিত প্রকাশ করেছে। সেই সময়ের তীব্র খাদ্য সংকটে ৮০ লাখ শরণার্থীর জন্য ৩০ লাখ টন খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা উল্লে­খ করে ১৩ সেপ্টেম্বর সংবাদ প্রকাশ করে টেলিগ্রাম। যুদ্ধজয়ের পর ২০ ডিসেম্বর ‘যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদন এখনও ঠান্ডা মাথায় গবেষণার বিষয়। ২৫ মার্চ কালরাতের দু’দিন পর ২৮ মার্চ লন্ডনের দ্য অবজারভারের মন্তব্যআশ্রয়ী প্রতিবেদন ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তাতে আগেভাগেই বলে দেওয়া হয়– রাশিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে। মস্কো উপলব্ধি করতে পেরেছে, পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানের গণহত্যা বন্ধ হতে পারে।

আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যুত্থানের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া গেছে। পাকিস্তান সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, শেখ মুজিবকে তারা ঢাকায় নিজ বাসভবনে আটকে রেখেছে। অন্যদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, তিনি চট্টগ্রাম রয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, ‘আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি; উপযুক্ত সময়ে ব্যবস্থা নেব।’ বাস্তবে ঠিক তাই ফলেছে। ইন্দিরা গান্ধী উপযুক্ত সময়েই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছেন। মস্কো যথাসময়ে যথাকার্য সম্পন্ন করেছে। শুধু সাংবাদিক নয়; দুনিয়ার রাজনীতিক-কূটনীতিক-রাষ্ট্রনায়কদের জন্যও সেখানে রয়েছে জানা-বোঝার অনেক উপাদান।

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন