- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- রাহুলের ওপর চড়াও হয়ে বিজেপির লাভক্ষতি
ভারত
রাহুলের ওপর চড়াও হয়ে বিজেপির লাভক্ষতি

ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) যেভাবে রাহুল গান্ধীর ওপর চড়াও হয়েছে, সেটি তাঁর এবং তাঁর দল কংগ্রেসের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। এই কংগ্রেস নেতাকে বিজেপি এত দিন নানাভাবে উপহাস করেছে। তাঁকে বিভিন্ন অবমাননাকর নামে ডেকেছে এবং তাঁর কথার কোনো গুরুত্ব নেই বলে তারস্বরে চিৎকার করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার গুজরাটের এক আদালতে মানহানির দায়ে রাহুলের ২ বছরের কারাদণ্ড ঘোষিত হয়। চার বছর আগে এক নির্বাচনী সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভারত থেকে বিপুল টাকা লুটে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নীরব মোদি ও ললিত মোদিকে লক্ষ্য করে দেওয়া এক বক্তব্যকে ছুতো করে রাজ্যটির এক বিজেপি বিধায়ক, যদিও তিনি ওই বক্তব্য দ্বারা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন না– রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলাটি করেন। এখানেই শেষ নয়। রায় ঘোষণার মাত্র এক দিনের মাথায় লোকসভায় রাহুলকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে সাবেক কংগ্রেস সভাপতির ভারতীয় লোকসভার সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়।
শাসক দলের এসব কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষের প্রশ্ন– কেন তারা তাকে এত ভয় পাচ্ছে? রাহুল গান্ধী যদি অপ্রাসঙ্গিক হন; তিনি যদি বোকা হন, যেমনটা বিজেপি আমাদের বিশ্বাস করাতে চায়; তাহলে কেন বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সাংসদ এবং দলের মুখপাত্ররা রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করতে এবং তাঁর প্রতিটি কথার প্রতি এভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে এত সময় ব্যয় করছেন?
আসলে বিজেপির ভয়ংকর এক তৎপরতা বর্তমানে আমরা দেখছি। সরকারদলীয় সাংসদরা মার্চের মাঝামাঝি থেকে বাজেট অধিবেশন পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে বারবার সংসদকে রাহুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা যুক্তরাজ্যে ভারতীয় গণতন্ত্রের বিষয়ে রাহুলের মন্তব্যের মাধ্যমে বিদেশে দেশের মানহানি হয়েছে– এ অভিযোগ এনে রাহুল গান্ধীকে পার্লামেন্টে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা যা করেছেন, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও অশোভন। ক্ষমতাসীন দলের সাংসদরা এভাবে সংসদীয় কার্যক্রম স্থগিত রাখেন– এমনটা নজিরবিহীন।
ফৌজদারি মানহানির মামলায় যেভাবে রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তাও বিরল ঘটনা। তাঁকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া এবং লোকসভায় অযোগ্য ঘোষণা করলেও বিজেপিকে অস্থির ও নার্ভাস দেখায়।
আইন বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছেন, ভারতের ফৌজদারি মানহানি আইন সেকেলে এবং অবশ্যই এর পরিবর্তন হওয়া জরুরি। মানহানির বিষয়টি দেওয়ানি অপরাধ হওয়া উচিত এবং এ অপরাধে মানুষকে জেলে পাঠানো উচিত নয়। রাহুলের বিরুদ্ধে এ রায়ের প্রভাব ওইসব রাজনীতিবিদের ওপরেও পড়বে, যাঁরা প্রচারণা কাজে নিয়োজিত। ভারতে নির্বাচনের মধ্যে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নেতারা এক ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন।
এমনকি রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে সুরাট আদালত যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কর্ণাটকের একটি নির্বাচনী সমাবেশে রাহুল গান্ধী যে মন্তব্য করেছিলেন, সে বিষয়ে গুজরাটের একটি আদালত কীভাবে অবস্থান নেন?
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি নিয়ম রয়েছে, যা নিম্ন আদালতকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। বিশেষ করে আদালত যদি তাঁদের স্বাভাবিক আঞ্চলিক এখতিয়ারের বাইরে কারও বিরুদ্ধে কাজ করেন, তা সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম মেনেই হতে হবে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে রাহুল গান্ধীর আইনজীবীর উদ্ধৃতি রয়েছে। তিনি আদালতকে বলেছেন, ‘রাহুল গান্ধী দিল্লির বাসিন্দা, যা ওই আদালতের এখতিয়ারের বাইরে। এই সব অভিযোগের ক্ষেত্রে সাক্ষীদের পরীক্ষা করা এবং বিষয়টি অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এর পর সমন জারি করা হবে কিনা, সে বিষয়ে আদালতকে কারণ জানাতে হবে। এমন পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি।’
আইনের বিষয় যদি আমরা বাদ দিয়েও বলি, এই বিষয়টি যে বিতর্ক তৈরি করেছে তাতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার সম্পর্কে আরও ফাটল সৃষ্টি করেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাহুল গান্ধীকে যেভাবে পার্লামেন্টে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, তা অপ্রত্যাশিতভাবে বিরোধীদের একত্রিত করেছে।
যে দলগুলো কংগ্রেস থেকে কিছুটা দূরে ছিল তারা কাছে এসেছে। যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, চন্দ্রশেখর রাওসহ অনেকেই, যাঁরা দিল্লির মসনদ দখলে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে মাত্র কয়েক দিন আগেও রাহুলের সঙ্গে ব্যাপক দূরত্ব বজায় রাখতেন– সংসদের স্পিকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরপরই রাহুলের সমর্থনে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। বিরোধীদের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ। তারা জানে, এটি তাদের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ। কারণ তারা সবাই সরকারের কাছ থেকে একই ধরনের আচরণ পেয়ে আসছে। যার মাধ্যমে তাদের কথা বলার স্থান সংকুচিত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন– কংগ্রেস কি এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে? কাকতালীয় হলেও সত্য, রাহুল গান্ধীকে আইনের যে প্রবিধান অনুসারে সাংসদ হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, সেই একই ধারাটি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার উল্টানোর চেষ্টা করছিল। মূল আইনে বলা হয়েছিল, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মানহানি মামলায় দোষী সাব্যস্ত একজন সাংসদকে অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে না। এটি সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা ২০১৩ সালে ‘লিলি থমাস বনাম দ্য ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ মামলার যুগান্তকারী রায়ে পরিবর্তন হয়েছিল; যেখানে বলা হয়েছিল, যদি একজন এমপি কোনো আদালতে ২ বছর বা তার বেশি সময়ে অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার যখন তা আগের ধারায় আনতে চেষ্টা চালায়, তখন রাহুলই এর বিরোধিতা করেন।
এখন যদি উচ্চ আদালত দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ওপর স্থগিতাদেশ দেন বা দোষী সাব্যস্ত আইনপ্রণেতার পক্ষে আপিল শুনানি মঞ্জুর করেন, তাহলে অযোগ্যতার আদেশ স্থগিত হয়ে যাবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিছক সাজা স্থগিত হলে হবে না; রাহুলের বহিষ্কারাদেশ বাতিল হতে হলে তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ওপর অবশ্যই স্থগিতাদেশ হতে হবে। মনমোহন সিং সরকার এটি বন্ধ করার জন্য একটি অধ্যাদেশ তৈরি করেছিল। রাহুল গান্ধী সেই অধ্যাদেশটি মিডিয়ার সামনে ছিঁড়ে ফেলেন, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে বিব্রত করেছিল, যিনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরে ছিলেন। পরে অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
মানহানি মামলায় দোষী সাব্যস্ত এবং পরবর্তী সময়ে সংসদ সদস্য হিসেবে রাহুল গান্ধীর বহিষ্কার জনমনে কংগ্রেস নেতার প্রতি যে সহানুভূতি তৈরি করেছে, সেটি তিনি ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারেন, যদি তিনি তাঁর রাজনৈতিক কার্ড সঠিকভাবে খেলেন। তিনি যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তার জন্য যদি তিনি জেলে যান, তবে তা কংগ্রেস শিবিরকে উজ্জীবিত করবে। নেতা হওয়ার জন্য তাঁর এমপি হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু কংগ্রেস কি এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে?
নিধি রাজদান: ভারতীয় সাংবাদিক; গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন