
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আশপাশের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনা আমরা দেখেছি। এমন সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি এমন ঘটনা ঘটছে বছরের পর বছর। এসব দলগত বিরোধ বা হাঙ্গামা আমাদের গা-সওয়া, বলা যায়। কোন ঘটনায় কার দোষ বেশি বা কম– সে প্রশ্নের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েও তারা জানে না কীভাবে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে হয়? যাঁদের অর্থে তারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, তাদের কীভাবে সম্মান করতে হয় তা না জানার কথা নয়। একজন রিকশাওয়ালা বা দিনমজুরের কাছ থেকেও নানাভাবে যে অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়, সে অর্থেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকা-খাওয়া, লেখাপড়া ইত্যাদি চলে নামমাত্র খরচে। যদি এই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ না আসত, তবে অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরই সেই অর্থে সামর্থ্য নেই তাঁদের সন্তানকে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করানোর। যারা একটি সমস্যাকে সময়মতো সুন্দর সমাধান করতে পারে না; যারা সাধারণ মানুষকে সম্মান করতে পারে না, তারা কীভাবে কিছুদিন পর দেশের সম্পদ হবে? কীভাবে তাদের ওপর ভর করে দেশ সামনে এগোবে? তারাই তো কয়েক বছর পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করবে।
যদি অন্য পক্ষেরও দোষ হয়ে থাকে; শিক্ষার্থীদের উচিত সেটাকে বিবাদের দিকে নয়; আপসের দিকে নেওয়া। কারণ, শিক্ষার্থী তো দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষা’ নিচ্ছে। আর অন্য পক্ষ তো তার মতো উচ্চশিক্ষিত নয়। শিক্ষিত মানুষের আচরণ তো এমন মারমুখী হতে পারে না। এ ধরনের সংবাদ পড়লে অনেক সময় নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। নিজে এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে আজও মনে হয়, আমাদের উত্তরসূরিদের দায় কিছুটা হলেও আমার ওপর বর্তায়। কেবল দলবদ্ধ বাজে আচরণ নয়; একক আচরণও আমাকে কষ্ট দেয়। লজ্জিত করে। আর যদি সেটা হয় কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা প্রাক্তন শিক্ষার্থীর। বছর দুই আগে একজন সরকারি কর্মকর্তা তাঁর বাবার বয়সী দু’জন প্রবীণ ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে কান ধরে উঠবস করিয়েছিলেন। সে ঘটনা সংবাদ হয়েছিল। তখনও লজ্জা পেয়েছিলাম। কারণ, সেই কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। কেন শিক্ষার্থীদের আচরণ আজও এমন অসহিষ্ণু? সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীর প্রতি আবেদন, আসুন একটু লজ্জিত হই। আসুন, মেধার অহম ঝেড়ে ফেলে সাধারণ মানুষের কাছে যাই! আসুন ঋণ শোধ করি!
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন মনে না করে, তারা বাবার পয়সায় পড়ে বলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করা বৈধ। সম্প্রতি লেগুনা চালক-হেল্পারের সঙ্গে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মারামারির ঘটনাও আমরা দেখেছি। এগুলো কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় কিংবা ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ সাধারণভাবে দেখার কারণ নেই। সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি অনেক বেশি ছড়িয়েছিল, যেখানে আহত দুই শতাধিক। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়েও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয়; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনা ভালোভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এসব সংঘাত বা সংঘর্ষ কমাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও দায় রয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তৎপর হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা ব্যবসায়ী নেতৃত্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার মধ্যে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর কল্যাণ রয়েছে। শিক্ষার্থীদেরও দায়িত্বশীল আচরণ প্রদর্শন করা জরুরি। সামান্য কিছুতে উত্তেজিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রাখা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরই দায়িত্ব।
মারুফ ইবনে মাহবুব: সমাজকর্মী
মন্তব্য করুন