লেবুর চাইতে লেবুর শরবত বেশি মজার। শরবতে যা পানি ও চিনি, রসালাপে তা গুজব বা মিথ। সত্যের চাইতে এসব বেশি উপাদেয়। ঢাকায় ইমতিয়াজ মোহাম্মদ ভুঁইয়া নামে একজন স্থপতিকে খুন করে লাশটা গুম করা হলো। নওগাঁয় একজন মা র‍্যাবের হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পরে মারা গেলেন। শুরুতে দুটি ক্ষেত্রেই ভিকটিমের ‘চরিত্রদোষ’ কিংবা কথিত অপরাধের বৃত্তান্ত বেশি প্রচারিত হলো। শুরুতেই ঘটনাগুলোকে অনৈতিকতার ফ্রেমে আটকে ফেলা হলো। ছবি যত বড়ই হোক, ফ্রেমের মাপ ছোটো হলে পুরোটা আর দেখা যায় না।

নওগাঁর জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে যিনি মামলা করেছেন, তাঁর মুখের চরিত্র হননকারী বয়ান কেন সংবাদমাধ্যমে ফলাও করা হবে? ওদিকে ফেসবুকবাসী অনেক রসলোভী এর ভেতর থেকে রস নিংড়াতে নামলেন। এভাবেই, এভাবেই দারোগার চোখ আর সোশ্যাল মিডিয়ার জনমত দু’জনে দু’জনার হয়ে ওঠে। কিন্তু মাছির মৃত্যু হয় রসে। রসে পাখনা ভারী হয়ে সে রসেই ডুবে মরে। যাকে বলে রসাতল। 

বিলাতের পুলিশের ওপর এক গবেষণায় দেখা যায়, অপরাধের চাইতে অপরাধের শিকার নিয়েই থাকা হয় বেশি। তদন্ত, মানসাঙ্ক, গবেষণা কত কী! ইমতিয়াজ মোহাম্মদের যৌন অভ্যাস কিংবা নিহত জেসমিন সুলতানার চরিত্র কেন বিষয় হয়ে উঠবে? হয়তো অপরাধের মোটিভ বোঝার জন্য দরকার, কিন্তু সেটা তদন্ত শেষের আগে প্রচারিত হবে কেন? আসল ঘটনা কোনটা?

দুটি ঘটনাতেই ভয়ংকর অপরাধ ঘটেছে বলে অভিযোগ। নিহতরা তো জবাব দেওয়ার জন্য নেই। ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অভিযুক্ত খুনিরা। কেউ খুনি আর কেউ খুনের শিকার। শিকারের দিকে নজর তাক করলে কি খুনি আড়ালে পড়ে যায় না? অনেকে হয়তো বুঝতেই পারেন না– তিনি নিজেও গুজব বা ক্ষতিকর মিথে আসক্ত।
ভিকটিম নারী হলে রসের মাছিদের সুবিধা হয়। ধনী-গরিব মিলিয়ে নারী ভিকটিমের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে দুরবিন তাক করা হয়। ভিকটিম গরিব হলে... আরে ওদের তো স্বভাব খারাপ। অশিক্ষিত হলেও তা-ই। অথচ চোখের ঠুলি খুললে দেখা যাবে, যাবতীয় অপরাধের হোতাদের বেশিরভাগই ধনী, শিক্ষিত এবং ক্ষমতাবান। ধন, শিক্ষা আর ক্ষমতা তাঁদের অপরাধের জন্য আরও বেশি যোগ্য করে তোলে।

১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমিন নামে এক শ্রমজীবী মেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। তখন এক দল বলা শুরু করল, মেয়েটি ‘পতিতা’ ছিল। আরে, যৌনকর্মী হলেই কি তাকে হত্যা-নির্যাতন করা যায়? মৌলিক অধিকারের ধারণাটা ভুলে বসে থাকি কেন? একজন ব্যক্তি যা-ই করুন, তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন, মর্যাদা রক্ষা এবং বিচারের আগে পর্যন্ত জীবন রক্ষার অধিকার আছে। এটা তাঁর হক। এই অধিকার তাঁকে দিচ্ছে সংবিধান।

অধিকার নিশ্চিতের দায়িত্বটা সরকারের। তবে কর্তব্য আছে জনগণ, সমাজ, প্রতিবেশী এবং আমার-আপনার। আমরাই যদি ন্যায়ের ধার না ধরি; সরকার ধারবে কেন?

এই ‘আমরা’ বলতে, জনগণ বলতে যা বোঝানো হয়, তার অংশ কিন্তু অপরাধী ও অপরাধের শিকার উভয়েই। ভালো-মন্দে মেশানো সমাজের জলবায়ুতে উভয়েই দম নিই ও ফেলি। কেউ ছাড়ি অক্সিজেন, কেউ ছাড়ি নষ্ট বাতাস। সুতরাং এর প্রভাব আমাদের ওপরেও পড়ে। তখনই অপরাধীর পক্ষের যুক্তি নিরপরাধও শেয়ার করছেন। তখনই ভিকটিম ব্লেমিংয়ের সংস্কৃতি জোরদার হয়। তাই সতর্ক থাকা দরকার– আমার চোখের ভেতরে বসানো আছে কার লেন্স। আমার দেখার আয়নাটা অন্যের দেওয়া না তো? আমি যা শুনতে চাই না, তা শোনা কি দরকার ছিল না? যা নিজ কানে শুনছি বলে ভাবছি, তা হয়তো শোনানো হচ্ছে বলেই শুনছি। দুর্বলের ফরিয়াদের চাইতে সবলের ছলনাগীত কিন্তু  বেশি আওয়াজে বাজে। এটা শুধু আমাদের দেশে না; অনেক দেশেই।

আমেরিকায় কোনো কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশের গুলিতে মারা গেলে বলা শুরু হয়, লোকটি নেশা করত কিংবা ছিল এক ছিঁচকে চোর। মুসলিম কেউ নিহত হলেই ‘জঙ্গি’ সিল লাগিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিটেনে সরকারের অর্থায়নে পুলিশ বাহিনীর ভেতর একটি গবেষণা জরিপ করা হয়। তাতে বের হয়ে আসে যে, সেখানকার পুলিশের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষণের শিকারের পোশাক বা আচরণকে দায়ী করার প্রবণতা বেজায় বেশি। যে পুলিশ কর্মকর্তারা ধর্ষণের তদন্ত করেন, তাঁদের মধ্যেই এই ভিকটিম ব্লেমিংয়ের ঝোঁক দেখা গেছে। এ ধরনের প্রবণতাকে বলে রেপ মিথ। মিথ তো আর সত্য না, কিন্তু সত্যের চেয়ে মিথে বিশ্বাসের মজা বেশি। লেবুর চাইতে যেমন লেমনেড। ওই গবেষণায় এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে ভিকটিম বা আক্রান্তকে বিশ্বাস করার প্রবণতা খুবই কম।

ওদিকে এক সংবাদমাধ্যম আরেক সংবাদমাধ্যমকে মহা শোরগোলে ফাঁসাতে চাইছে। লাভ হচ্ছে কার? কার লাভ জানি না, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষমতাবানদের মিথ্যা নিয়ে তো এত মাতামাতি হয় না। এক নির্যাতিত আরেক ধর্মের বা জাতির লোককে নির্যাতনে সায় দিচ্ছে বা নির্যাতিতকেই শত্রু ভাবছে। অপরাধী নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, ভিকটিম হয়ে উঠছে আলোচনার বিষয়। এর একটা নাম আছে। একে বলা যায় ‘সোশ্যাল ক্যানিবালিজম’ বা সামাজিক স্বজাতিভক্ষণ। বাস্তবে ক্যানিবালিজম বা নরমাংস ভক্ষণের যেসব গল্প ইউরোপীয়রা শুনিয়েছিল আফ্রিকান বা মায়া সভ্যতার ব্যাপারে, সেগুলো নিছক প্রচারণা। দখলদারি ন্যায্যতা দিতে অধীনস্ত জাতিকে খারাপ বা অসভ্য বলে দেখানো একটা কৌশল। এগুলো সত্য না; রূপক।

ওই রূপক গল্প আমাদের দেশে সত্যি হতে দেখছি। অপরের ক্ষতি চাওয়া এর ছোট রূপ। বড় রূপ হলো– অবিরত হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও গণপিটুনির হিড়িক। এই দুয়ের মাঝখানে থাকে ভিকটিম ব্লেমিংয়ের মানসিকতা। এসবের মধ্যে বড় ধরনের সামাজিক বিপর্যয়ের সতর্ক সংকেত লুকিয়ে আছে। তা পাঠ করে সজাগ না হলে সত্য আর মিথ্যা আলাদা করা যাবে না। নিপীড়ক আর নিপীড়িতের মধ্যে পার্থক্য গুলিয়ে যাবে। সমাজ আরও ধ্বংস হবে। 

ওদিকে মজা নিচ্ছেন ফজা ভাইয়েরা। 

ফারুক ওয়াসিফ: সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক, লেখক

farukwasif0@gmail.com