এমন কোনো সমস্যা নেই, পাকিস্তান এখন যার মুখোমুখি নয়; এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যাকে এর জন্য দায়ী করা হয়নি; আবার এমন কোনো সমাধান নেই, যা সামাজিক মাধ্যমে এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তুলে ধরা হয়নি। তথাপি এখনও আমাদের অধঃপতন অব্যাহত।
আমাদের দুর্ভাগ্যের কারণ খুঁজে বের করার প্রয়াসে আমি পাকিস্তানের সঙ্গে এ অঞ্চলের সেসব দেশের অবস্থানের একটা তুলনা হাজির করছি, যেগুলো ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ৭৫ বছর কিংবা তার আগে স্বাধীন হয়েছে। দেশগুলো হতে পারে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, বার্মা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ। ২০২২ সালের আইএমএফের হিসাবে সিঙ্গাপুরের মানুষের মাথাপিছু আয় ৭৯ হাজার ৪২৬ ডলার। মালয়েশিয়ার ১৩ হাজার ১০৮ ডলার; শ্রীলঙ্কার ৩ হাজার ২৯৩ ডলার; বাংলাদেশ ২ হাজার ৭৩৪ ডলার; ভারতের ২ হাজার ৪৬৬ ডলার; পাকিস্তান ১ হাজার ৬৫৮ ডলার এবং মিয়ানমার ১ হাজার ১০৫ ডলার।

এ তালিকায় পাকিস্তান ও মিয়ানমার রয়েছে সবার নিচে। এ দুই দেশের মধ্যে সাধারণ মিল রয়েছে কোন বিষয়ে? মিয়ানমার বার্মা হিসেবে স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তবে ১৯৫৮ সালের মধ্যে দেশটি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু করলেও রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। সেনাবাহিনীর কট্টরপন্থিরা তখন সুযোগ বুঝে একটি কার্ড খেলে এবং সেনাপ্রধান জেনারেল নে উইনকে ক্ষমতা দখলের জন্য ‘আমন্ত্রণ’ জানায় । নে উইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৬০ সালে নির্বাচন করেছিল। কিন্তু ১৯৬২  সালে আরও ১৬ জেনারেলের সঙ্গে অভ্যুত্থান ঘটান। নে উইন একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর অবস্থান সুসংহত করেন। ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করলেও তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা ধরে রাখেন। একই বছর নতুন সংবিধান জারি করা হয় এবং নে উইন রাষ্ট্রপতি হন।

১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বার্মিজ জনগণ মনে করেছিল, উ থান্টকে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, যা তাঁর প্রাপ্য ছিল। এর ফলে সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহ চলতে থাকে। তবে নে উইন ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মমভাবে দমন করেন। তিনি ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করলেও ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সামরিক পৃষ্ঠপোষণাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দল সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে বাইরে থেকেও ক্ষমতার  কলকাঠি নাড়েন। ১৯৮৮ সালে শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়নের ফলে সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর আরেক জেনারেল স মং দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৯০ সালে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল; কিন্তু সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দল বিজয়ী না হওয়ায় তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ১৯৯২ সালে স মংয়ের স্থলে জেনারেল থান শোয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, যিনি জনপ্রিয় নেত্রী অং সান সু চির ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছিলেন এবং ১৯৯৫ সালে তাঁকে মুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীকে প্রধান ভূমিকায় রাখার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বারবার ন্যাশনাল কনভেনশন (পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সমতুল্য) স্থগিত করেন। অবশেষে ১৯৯৬ সালে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। সামরিক বাহিনী আবার ২০০০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত জনপ্রিয় নেত্রী সু চিকে গৃহবন্দি করে রাখে। মুক্তি পাওয়ার এক বছর পর তাঁকে হেফাজতে নেওয়া হয়। ২০০৫ সালে সরকার সংবিধান পুনর্লিখনের প্রয়াসে ১৯৯৩ সালের পর আবার জাতীয় কনভেনশন প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে তখন গণতন্ত্র শুধু নির্দিষ্ট কিছু দলের জন্য নির্ধারিত ছিল। সেখানে সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি পার্টিকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

২০০৭ সালে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়; কিন্তু সে আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করা হয়। ২০০৮ সালে নতুন সংবিধানের জন্য গণভোট এবং ২০১০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়। সামরিক সমর্থিত সরকার ২০১১-১২ সালে গণতান্ত্রিক অনেক সংস্কার চালু করে এবং অং সান সু চিকে মুক্তি দেয়। এসব গণতান্ত্রিক সংস্কার পশ্চিমাদের দ্বারা প্রশংসিত এবং পুরস্কার হিসেবে মিয়ানমারকে আসিয়ানের চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং ২০১৬ সালের মার্চ মাসে তিনি ‘স্টেট কাউন্সেলর’ পদ গ্রহণ করেন, যা প্রধানমন্ত্রীর মতো একটি পদ।

মিয়ানমারে ২০২০ সালের নির্বাচনে দুর্বল শাসন, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিগত বিরোধ সত্ত্বেও সু চির এনএলডি পার্লামেন্টে ৪৭৬ আসনের মধ্যে ৩৯৬টি আসন জিতেছিল। যেখানে সামরিক সমর্থক ইউএসডিপি মাত্র ৩৩টি আসন জিতেছিল। এর পর সামরিক বাহিনী ২০২১ সালে সু চিকে আটক এবং ক্ষমতা দখল করে। এবারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, সেখানে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। সশস্ত্র বিদ্রোহ ও সংকটের কারণে কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং কয়েক হাজার মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যায়।

শেষ কথা হলো, পাকিস্তানসহ এই অঞ্চলের যে কোনো দেশের তুলনায় মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর শাসন বেশি বিস্তৃত এবং দীর্ঘায়িত হয়েছে। তাই তারা অর্থনীতির সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে এক ধাপ নিচে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা যত বেশি হবে, দেশ তত দরিদ্র হবে।

তাসনিম নূরানী : পাকিস্তানের সাবেক আমলা ও পিটিআইর পরামর্শক কমিটির সদস্য। ডন থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক