স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে এই প্রশ্ন জেগেছিল– শতবর্ষ পরে তাঁকে কেউ কি মনে রাখবে? সেখানে আমাকে, আপনাকে বা আমাদেরকে শতবর্ষ পরে কেউ কেন মনে রাখবে? শতবর্ষ আগে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবাইকে কি আমরা মনে রেখেছি? জীবনে কেউই অমর নয় সত্য; কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে কারও কারও অমরত্বের রহস্য কী?

জীবন তো ক্ষণস্থায়ী; পদ্মপাতার জল। বাউলের উপলব্ধি– ‘একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর রে মন আমার, কেন বান্ধ দালান-ঘর।’ এটাই নির্মম সত্য। কিন্তু এই ক্ষুদ্র জীবনের চলার পথে আমরা কি তা মনে রাখি? কত ভালোবাসা! কত স্বপ্ন! জীবনকে ঘিরে কত আয়োজন! জীবন সাজাতে, জীবন রাঙাতে মেধা-শ্রম-সময়ের কী অফুরান বিনিয়োগ! অথচ ভেবে দেখি না, পৃথিবী থাকার স্থান নয়; চিরদিন এখানে থাকা যায় না। কেউ থাকেনি, থাকতে পারেনি, থাকতে পারবেও না; থাকা সম্ভব নয়। থাকা নয়, বরং চলে যাওয়াই সুনিশ্চিত। তারপরও আমরা আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখি, সোনার হরিণ বা মরীচিকার পেছনে আমৃত্যু দৌড়েই চলেছি।

এখন ২০২৩ সাল। আজ থেকে ১০০ বছর পরে, ক্যালেন্ডারের পাতায় যখন ২১২৩, তখন আমাদের একজনও হয়তো বেঁচে থাকব না। প্রত্যেকে আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। আমাদের প্রায় প্রত্যেকের দেহ তখন মাটির নিচে; অস্তিত্ব তখন রুহের জগতে। ফেলে যাওয়া সুন্দর বাড়িটা, শখের গাড়িটা, জমিজমা, ধনসম্পদ, টাকা-পয়সা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তখন ভোগ করবে। একই নিয়মে দিন চলবে, সেই সঙ্গে কর্মযজ্ঞ। তখন কি আমার কথা কেউ ভাববে? পরবর্তী প্রজন্ম কি আমাকে বা আমাদের মনে রাখবে? আমার স্মৃতিচারণ করবে? নাকি যাদের জন্য সব করতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলাম, তাদের হাতে সময় হবে কি আমাকে মনে রাখার? তারা হয়তো তখন নতুন স্বপ্নে বিভোর, নতুন উদ্যমে জীবন সাজাচ্ছে। সেই একই চক্রে বাঁধা পড়ছে অজান্তে। 

যদি নিজেদের প্রশ্ন করি– আমরাই কি আমাদের ১০০ বছর আগের প্রজন্মকে মনে রেখেছি? আমাদের দাদার দাদা, নানার নানা বা অন্য পূর্বপুরুষদের কথা কি আমরা জানি? তাঁদের নামটাই বা আমরা কতজন বলতে পারব? মাত্র দু-তিন পুরুষের ব্যবধানে নামটা পর্যন্ত হারিয়ে যায়; পরিচয় তো পরে। নেহাত যুগশ্রেষ্ঠ পুরুষ বা নারী না হলে সবাই হারিয়ে যায় কালের অন্তরালে। তাহলে ১০০ বছর পর ওই সময়ের প্রজন্মের কেউ কেনই বা আমাদের মনে রাখবে!

এই ভাবনা কষ্টকর বৈকি। তাহলে পৃথিবীতে এসে এত কিছু অর্জন করে আমাদের কী লাভ হলো? যে পিতামাতা সন্তানের জন্য জীবনের সব সময়, শ্রম, ধনদৌলত বিনিয়োগ করেছিলেন; পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন; নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। চলে যাওয়ার পর তাঁদের কথা কেউ মনে রাখে না, ভাবে না, স্মরণ করে না– এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে! আসলে এই পৃথিবীতে নিজের বলে কিছু নেই। জীবনের যা অর্জন, তার কিছুই মৃত্যুর পর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে না। একমাত্র আকুতি– যদি বেঁচে থাকা যায় কারও স্মৃতি হয়ে। কিন্তু এ ভাগ্যই বা কয়জনের হয়? শূন্য থেকে এসে আবার শূন্যতেই মিলিয়ে যাওয়া– মানবজন্মের এই বোধহয় সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।

আসলে আমরা কীসের পেছনে ছুটে চলছি? একেবারে শৈশব থেকে যে প্রচণ্ড দৌড়; এর গন্তব্য কোথায়? আমরা স্কুলে ভালো রেজাল্ট, কর্মে সাফল্য আর পদোন্নতি; অর্থ-যশ-খ্যাতি-ক্ষমতার জন্য ছুটে চলি। অন্যকে টেনে নামানো, ছিদ্রান্বেষণ, কালিমা লেপনে ছোটাছুটির অন্ত নেই। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও কত প্রাণান্তকর চেষ্টা! তাতে কি শেষরক্ষা হয়? এক সময় কিন্তু দেহটাই শেষ হয়ে যায়। শেষকালে মনে হয়– ‘তুমি কার, কে তোমার!’ দৌড়ই যার একমাত্র কর্ম; গন্তব্যেই তার সমাপ্তি। অনাগত কাল কেন তবে আমাকে মনে রাখবে?


চলে যাওয়া অসংখ্য প্রজন্মের পথ বেয়ে আমরা এই জীবন লাভ করেছি। আবার আগামীতে এমনই অসংখ্য প্রজন্মের ভিড়ে আমরা হারিয়ে যাব। এই অনন্ত মিছিলের মাঝে নিজেকে কীভাবে তুলে ধরা যায়? এক আকাশ নামহীন তারার মাঝে ধ্রুবতারা হওয়ার মূলমন্ত্র কী? ভালো কাজ।

জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যু। মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। পাড়ি জমাতে হবে পরপারে। তাকে ফাঁকি দিয়ে মানুষের মনের জগতে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ভালো কাজ। মানুষের জন্য কাজ করে, মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করে, মানুষের প্রয়োজনে নিজের সময়-সম্পদ-সামর্থ্য ঢেলে দিয়েই মানুষের স্মৃতিতে স্থান করে নেওয়া সম্ভব।

মানুষ তো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু তেমন আচরণ কি আমরা করছি? আমরা কি নিজের সময়, শ্রম, জ্ঞান মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করছি? বরং এর বিপরীত। আমরা যা বলি আর যা করি– এই দুইয়ের মধ্যে থেকে যায় বিস্তর ফারাক। একটুতেই একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লেগে যাই। নিজ স্বার্থে সামান্য আঘাত এলে কটু কথা বলতে দ্বিধাবোধ করি না।

আমরা সামান্য কারণে মানুষের প্রতি বিরাগভাজন হই, অপরকে ঠকাই, পরনিন্দা করি, অন্যের হক নষ্ট করি, অবিচার করি, মারামারি করি। এমনকি মানুষও খুন করে ফেলি। মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, লোভ-লালসা, অহংকার, অসহনশীলতা, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থপরতা এখন সারাবিশ্বে ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।

মানবিক মূল্যবোধ, মায়া-মমতা, মানবতা-পরার্থপরতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মানুষ এখন স্বার্থের জালে এমনভাবে বন্দি, তারা সময়ে সময়ে অন্ধ হয়ে যায়। স্বার্থের জন্য ভাই ভাইয়ের বুকে, সন্তান পিতা-মাতার বুকে, স্বামী স্ত্রীর বুকে, স্ত্রী স্বামীর বুকে ছুরি বসিয়ে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, দলবদ্ধ ধর্ষণ, অপহরণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন; এমনকি শিশু নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যা; পারিবারিক ও সামাজিক কোন্দল এবং হতাহতের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অথচ ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে অহংকার কিংবা নাশকতা কোনোটাই শোভা পায় না। কারণ এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা আমার কিংবা আপনার নয়। কোনো কিছু কি আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন? আমরা শূন্য হাতে এসেছি; শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে। নতুন জগতে ২১২৩ সালে কবরে শুয়ে হয়তো আমরা সবাই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারব– সত্যি দুনিয়াটা কতই না তুচ্ছ ছিল! একে ঘিরে দেখা স্বপ্ন কতই না নগণ্য ছিল!

এই স্বল্প সময়ে নিজেরা নিজেদের মাঝে লাভ আর লোভের জন্য প্রতিযোগিতা না করে যদি দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করি; নিজের জ্ঞানকে জনকল্যাণে ব্যবহার করি; ভোগবিলাসে মত্ত না হয়ে নিজের সামান্য যা কিছু প্রয়োজন, তাতে সন্তুষ্ট হয়ে বাকিটা সমাজের জন্য বিলিয়ে দিই, তবেই মানুষ আমাদের মনে রাখবে। জীবনে ভালো থাকার জন্য কাউকে জুলুম করে, কারও হক নষ্ট করে পয়সার মালিক হওয়ার চেয়ে সবাইকে ভালোবেসে, সবার ভালোবাসা নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া; অন্নহীনকে অন্ন আর বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া; জ্ঞানের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হবে– এমন কিছু করাই উত্তম। এই নশ্বর জীবনে আমাদের যা কিছু অর্জন– হোক তা সম্পদ, জ্ঞান, খ্যাতি বা প্রভাব; যদি মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করা যায়, তবে তাই হবে শতবর্ষ পরেও মানুষের মনের মুকুরে বেঁচে থাকার উপলক্ষ। মৃত্যুর পর মানুষের মনে থাকার চেয়ে বড় কোনো অর্জন আর কী হতে পারে!

ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক; ইমেরিটাস অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়