গত ১ মার্চ থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন স্লোগান– টিকিট যার ভ্রমণ তার। মূল উদ্দেশ্য ট্রেন টিকিটের কালোবাজারি রোধ। ১৮৬২ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রথম রেলপথ এসেছে। তখন থেকে শুরু করে গত শতাব্দীর শেষ নাগাদ আন্তঃনগর ট্রেন চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট বিক্রি হতো ট্রেন ছাড়ার আধা ঘণ্টা আগে থেকে। বড় স্টেশনে ঘণ্টা দুই আগে। প্রথম শ্রেণির টিকিট কিছুটা আগেভাগে রিজার্ভ করা যেত। দেড় শতাব্দীর অধিক প্রাচীন রেলওয়েতে পরিবর্তন এসেছে অনেক। তার মধ্যে বড় পরিবর্তন সম্ভবত সব শ্রেণির টিকিট আগাম বিক্রি।
আমাদের দেশে শুধু নয়; একদা পাশের দেশেও রেলওয়ের টিকিট কালোবাজারি করা ছিল অনেকের পেশা; জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। কলকাতাকেন্দ্রিক গল্প-উপন্যাসে টিকিট কালোবাজারিরাও দখল করে থাকত বেশ বড় অংশ। ভারতীয় রেলওয়ে থেকে এখন ‘কালোবাজারি’ শব্দ উধাও। কোন সে জাদুমন্ত্র! সে জাদুমন্ত্র প্রয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়েও। মন্ত্রটি হলো আগাম টিকিট বিক্রি।

বাজারের চাহিদা অনুযায়ী যদি জোগান কম থাকে তবে কালোবাজারির সুযোগ নেওয়া লোকের অভাব হয় না। ট্রেনের টিকিটের অবশ্য জোগান অফুরান নয়। তবে ব্যবস্থাপনায় কৌশল থাকলে লোপ পেতে পারে কালোবাজারি।

কৌশল হিসেবে ভারতে ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি হয় ১২০ দিন আগে; শ্রীলঙ্কাতেও তাই। সুইডেন ও থাইল্যান্ডে ৯০ দিন আগে। ব্রিটেন ও ইন্দোনেশিয়ায়  ১২ সপ্তাহ মানে ৮৪ দিন আগে। পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও সুইজারল্যান্ডে রেলওয়ের টিকিট বিক্রি হয় ট্রেন ছাড়ার ৬০ দিন আগে থেকে। চীনে অবশ্য এত দিন নয়। তারা টিকিট বিক্রি করে মাত্র ৩০ দিন আগে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি দিন আগে টিকিট বিক্রি হয় কানাডায়; ৩৩১ দিন বা ১১ মাস আগে আগাম টিকিট বিক্রি করে থাকে। বাংলাদেশে টিকিট বিক্রি হয় পাঁচ দিনের আগাম। আমাদের চেয়েও কম দিনে আগাম টিকিট বিক্রি করে থাকে মিয়ানমার। সেখানে সাধারণ শ্রেণির আসন এক দিন আগে, উচ্চ শ্রেণির আসন তিন দিন আগে এবং স্লিপার এক বা দুই সপ্তাহ আগে বুক করা যেতে পারে।   

বাংলাদেশে আগাম টিকিট বিক্রির দিনসীমা কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে। সর্বশেষ ৫ এপ্রিল ২০২১ থেকে আগাম টিকিট বিক্রির সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ দিন। তার আগে ছিল ১০ দিন। পাঁচ দিন সময়সীমা নির্ধারণের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে এই– মানুষ খুব বেশি আগে ভ্রমণ পরিকল্পনা করে না। তাই পাঁচ দিন হলে মানুষ ভ্রমণ পরিকল্পনা করার পর টিকিট ক্রয় করতে পারবে।

অনলাইনে আমাদের রেলওয়ের টিকিট কাটার সময় একই সঙ্গে ফিরতি টিকিট কাটার কোনো সুযোগ নেই। ফিরতি টিকিট কাটতে হয় একই নিয়মে, যেমন করে অনলাইনে বা কাউন্টারে যাওয়ার টিকিট কেনা হয়। যাত্রার পাঁচ দিন আগে যখন যাওয়ার টিকিট ক্রয় করা হয় তখনও ফেরার টিকিট ছাড়া হয় না। ফলে দেখা যায়, অনেক সময় যাওয়ার টিকিট পাওয়া গেল তো পাওয়া গেল না পরে ফিরতি টিকিট। ফিরতি টিকিট না পাওয়ায় অনেককেই ট্রেন ভ্রমণের পরিকল্পনায় ক্ষান্ত দিতে হয়।

১ মার্চ থেকে ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ নীতির আওতায় টিকিট ক্রয়ের আগে যাত্রীকে নিবন্ধিত হতে হবে। নিবন্ধিত যাত্রী জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট নম্বর যুক্ত করে একসঙ্গে চারজনের টিকিট কাটতে পারছেন। ট্রেনে পর্যাপ্ত সংখ্যক টিটিই (ট্রেন টিকিট এক্সামিনার) না থাকায় প্রকৃতই টিকিট যার ভ্রমণ তার হচ্ছে কিনা, তা শতভাগ যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না।

জুতা আবিষ্কার কবিতার হবুচন্দ্র রাজার মতো ধুলা থেকে পা রক্ষা করার বাসনায় পৃথিবীকে চামড়ায় মুড়ে দেওয়ার চিন্তায় রেল কর্তৃপক্ষ নিবন্ধিত যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লাভের মধ্যে প্রকৃত যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়লেও কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য লোপ পায়নি।

ট্রেনের টিকিটের কালোবাজারি রোধ করতে হলে অন্যান্য দেশের মতো দীর্ঘ সময় আগে টিকিট বিক্রির চল শুরু করা দরকার। এখন একজন কালোবাজারিকে সর্বোচ্চ মাত্র পাঁচ দিনের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। ২০২১ সালের ৫ এপ্রিলের আগে যখন ১০ দিন আগে টিকিট কাটা যেত তখন একজন কালোবাজারিকে ১০ দিনের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ করতে হতো বলে কালোবাজারি কম হতো। আগাম টিকিট বিক্রির সময়সীমা যত বেশি হবে, কালোবাজারিদের পুঁজি বিনিয়োগের সময় তত বৃদ্ধি পাবে, যা কালোবাজারিদের জন্য কখনোই সুবিধাজনক নয়। ভারতে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ দীর্ঘদিন আগে আগাম টিকিট বিক্রি।

কালোবাজারি রোধে ও ভ্রমণ স্বাচ্ছন্দ্যময় করার জন্য ট্রেনের আগাম টিকিট ভারত বা শ্রীলঙ্কার মতো ১২০ দিনের আগাম করা যেতে পারে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দ্বিধা থাকলে পাকিস্তানের মতো ৬০ দিনের আগাম করা যেতে পারে। নিকট প্রতিবেশী কাউকে অনুসরণ না করতে চাইলে ৯০ দিনের আগাম  টিকিট বিক্রয়ের ব্যবস্থা নিলে তাও মন্দ হবে না। 

টিকিট ক্রয়ের সময় যাত্রী একই সঙ্গে ফিরতি টিকিট যাতে ক্রয় করতে পারে, সে ব্যবস্থাও নেওয়া দরকার। যাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধনের নিয়ম তুলে দিয়ে টিকিট ক্রয়ের সময় প্রত্যেক যাত্রীর ফটো, জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্টের নম্বর সেই সঙ্গে যাত্রীর বয়স ও জেন্ডার যুক্ত করা হলে টিটিইদের পক্ষে টিকিট যাচাই সহজতর হবে এবং টিকিট যার ভ্রমণ তার নীতিও বাস্তবতা লাভ করবে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর স্বল্পপাল্লার বিরতিও বিনা টিকিটে ভ্রমণ, কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট ক্রয় এবং আসনবিহীন ভ্রমণকে উৎসাহিত করে। তাই আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর স্বল্পপাল্লার বিরতিও তুলে দেওয়া দরকার।

জুতা আবিষ্কার কবিতার মতো পৃথিবীটাকে চামড়ায় মুড়ে দেওয়ার ভাবনা থেকে বেরিয়ে পা দুটোকে চামড়ায় মোড়ানোর মতো  কালোবাজারি রোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। মুহম্মদ বিন তুঘলকের মতো করে নয়; সিদ্ধান্ত হোক পড়শি দেশগুলোর মতোই, যারা দূর করেছে ট্রেন টিকিটের কালোবাজারি। 

আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব