
রোজা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। রোজা শব্দটি ফারসি, যার আরবি হলো সওম। সওমের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় সওম বলা হয়– প্রত্যেক সুস্থ, স্বাভাবিক, সাবালক, সজ্ঞান মুসলিম নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে স্ত্রী সহবাস, পানাহার এবং রোজা ভঙ্গকারী যাবতীয় অশালীন কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা। (সূত্র: বিনায়া ৪/৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৭)
রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসকে আখ্যায়িত করেছেন ‘শাহ্রুল মাওয়াছাত’ নামে; যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস। তাই গরিব-দুঃখী, দুস্থ, অনাথ, অসহায়, ভুখা-কাঙালদের ব্যথা-কষ্ট উপলব্ধি করে তা দূর করার জন্য আমাদের এ মাসে অধিকতর যত্নবান হওয়া উচিত। এ জন্য এই পবিত্র মাসে খাদ্যের অপচয় তো নয়ই; নিজেদেরও খাবার গ্রহণে পরিমিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পেট ভর্তি করে খাবার খায়, তার ওই পেট একটি নিকৃষ্ট পাত্র।’ (আহমাদ শরিফ, হাদিস ৩, পৃষ্ঠা ১৬৪) তিনি অতিভোজনকে কখনোই পছন্দ করতেন না। সে জন্যই তিনি মুমিনদের বলেছেন পেটের তিন ভাগের এক ভাগ খাবার, এক ভাগ পানীয় দিয়ে পূরণ করতে, অন্য এক ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখতে। (সহি তিরমিজি শরিফ, হাদিস নম্বর ২৩৮০)
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন মাজিদের সুরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘তোমরা খাও ও পান করো। কিন্তু কোনো অবস্থাতে অপচয় করো না। আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ সুরা বনি ইসরাইলের আয়াত ২৬-২৭-এ আল্লাহ বলেন, ‘… তোমরা কিছুতেই অপব্যয় করো না। কারণ অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই...।’
রমজান সিয়াম সাধনার মাস। আর সাধনা মানেই হচ্ছে সব পার্থিব লোভ-লালসা, ভোগ-বিলাসিতা, অপচয়-অপব্যয়-অপব্যবহার ও সব ধরনের রিপুর দমন। অথচ আমরা এ মাস এলেই অতিভোজন আর অপচয়ের মহোৎসবে মেতে উঠি। সরকারি পরিসংখ্যানও বলছে, সারাবছর ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেল ইত্যাদির যত চাহিদা থাকে, শুধু রমজান মাসেই লাগে তার এক- তৃতীয়াংশেরও বেশি। মাসব্যাপী সর্বত্র তথাকথিত ইফতার পার্টির নামে যা চলে, তাতে অতি দামে কেনা খাদ্যের অপচয়ও হয় বেশ।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইফতার ও সেহরি ইফতার: হজরত আবদুল্লাহ বিন আবি আউফ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রোজায় আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফরসঙ্গী ছিলাম। সূর্যাস্তের সময় তিনি একজনকে ডেকে বললেন, ‘ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতারি পরিবেশন করো।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস ১০৯৯)
সেহরি: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেহরিও ছিল এমনই সাদাসিধা। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, সেহরির সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি রোজা রাখব, খাবার দাও। আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে খেজুর ও পানি পরিবেশন করলাম। অন্য হাদিসে এসেছে, মুমিনের উত্তম সেহরি হচ্ছে শুকনা খেজুর। (আবি দাউদ শরিফ, হাদিস ২৩৪৫)
রোজার জাগতিক উপকারিতাও নেহাত কম নয়। রোজার মাধ্যমে মানুষের ভেতর সবর, শোকর, সহমর্মিতার মতো মহৎ গুণাবলি সৃষ্টি হয়। লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, হিংস্রতার মতো ক্ষতিকারক স্বভাব দূর হয়ে যায়। এ ছাড়া বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানও বলছে, শারীরিক সুস্থতায় রোজার ভূমিকা ব্যাপক ও প্রশংসনীয়। এই রোজা মূলত অসীম করুণাময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিন বান্দার জন্য বিশেষ উপঢৌকন; আল্লাহ তায়ালার সোহবত লাভের উত্তম উপায়; পরকালীন নাজাত লাভের উৎকৃষ্ট মাধ্যম; আত্মশুদ্ধির কার্যকর প্রক্রিয়া; ইবাদত-বন্দেগি কবুল করার সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তাই মুমিন মুসলমানের উচিত শরিয়তে বর্ণিত বিধানাবলি পালন করে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে রোজার ফাজায়েল ও ফাওয়ায়েদ অর্জনে সদা তৎপর থাকা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে রোজার তাৎপর্য অনুধাবন করে তা পালন করার তাওফিক দান করুন।
অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ শাহ জালাল: আইনজীবী ও আহ্বায়ক, সুফিবাদী নাগরিক মজলিশ–সুনাম
বিষয় : ইসলাম ও সমাজ মোহাম্মদ শাহ জালাল
মন্তব্য করুন