স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি কেন ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং এই আন্দোলন-সংগ্রামের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যাগের পেছনে কী প্রেরণা কাজ করেছে– এর সুলুক সন্ধান করলে বেরিয়ে আসে যে গল্প, তা শুধুই খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা আর নিরেট দেশপ্রেমের কথা।

স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এমন একজন রাজনীতিক। ‘আপনার মৃত্যু হলে আমরা প্রধানমন্ত্রী কাকে করব’– মৃত্যুশয্যায় কংগ্রেসপ্রধান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কথা বলেন।  দরিদ্র পরিবারের ছেলে লালবাহাদুর শাস্ত্রী। শৈশবে বাবা মারা গেলে মা তাঁকে অনেক কষ্টে মানুষ করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রথম বাড়ি গেলে মা অবাক হয়ে দেখেন– অসংখ্য মানুষের ভিড়। সাংবাদিকরা তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘বলো কী! আমার লালু প্রধানমন্ত্রী হয়েছে! আমাকে জানায়নি তো!’ দেশের দায়িত্ব তাঁর কাছে এতই বড় যে নিজের মাকেই সুখবরটা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি লালবাহাদুর শাস্ত্রী।

নেহরুর কেবিনেটে শাস্ত্রী শেষদিকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী ছিলেন। নেহরু তাঁকে একবার কাশ্মীর পাঠাতে চাইলেন। সবকিছু বুঝে নিয়ে শাস্ত্রী বেরিয়ে গেলেন। নেহরু ভাবলেন, কাশ্মীরে তো এখন অনেক শীত, কিন্তু শাস্ত্রীর তো শীত নিবারণের জন্য কোনো কোট নেই। ডেকে পাঠালেন শাস্ত্রীকে। বললেন, ‘তুমি যে কাশ্মীর যাবে; তোমার কি কোট আছে?’ শাস্ত্রী আমতা আমতা করায় নেহরুর কাছে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হলো। তখন নেহরু তাঁকে নিজের কোটটা দিয়ে বললেন, ‘এবার যাও। কাশ্মীর থেকে ঘুরে এসো’। দীর্ঘদেহী নেহরুর কোট তাঁর গায়ে খুব বেমানান ছিল বটে; কিন্তু আর কোনো উপায় ছিল না।   

অসহায় দরিদ্র মানুষের প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের যে ভালোবাসা ছিল, তা অনেক কমিউনিস্টের মধ্যেও বিরল। ১৯৭১-এর ৩ মার্চ প্রদত্ত শেখ মুজিবের ভাষণের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে দরিদ্র, ছিন্নমূল, বাস্তুহারা– এমনকি বিহার থেকে আগত বাস্তুহারা মানুষও নিয়ে তাঁর গভীর দুশ্চিন্তার কথা। তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে ট্যাক্সের টাকা দাবি করছেন বাস্তুহারা মানুষদের একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।

১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সামসুল হুদা দেখা করতে যান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এর মাত্র দু’দিন আগে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন সামসুল হুদা। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পান সামসু। বঙ্গবন্ধু তখন দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা মুড়ি খাচ্ছেন।

সামসুকে দেখে বললেন, ‘কেমন আছিস? আয়, মুড়ি নে।’ মুড়ি নিতে গেলে সামসুর হাতের আংটি দেখে বঙ্গবন্ধু অবাক হয়ে জানতে চান, ‘তোর হাতে রিং কেন রে?’ সামসু বলেন, বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কিছুটা অনুযোগের সুরে বললেন, ‘এখনই বিয়ে করে ফেললি? এখনও কত কাজ বাকি!’ দু’এক কথার পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বৌমা কোথায়? বৌ-এর জন্য কী কিনেছিস?’ সামসু নিচু স্বরে জবাব দিলেন, ‘কিছুই কিনিনি; আমি বেকার। হঠাৎ করে বিয়ে। এর আগে আমি মেয়েকে দেখিওনি।’ এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তার কোমরে ১০ হাজার টাকা গুঁজে দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই টাকা শুধুমাত্র বৌমার জন্য; এক টাকাও তুই নিবি না।’ এর পর বঙ্গবন্ধু আরও দেড় হাজার টাকা দেন সামসুকে। বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহমেদকে ডেকে পাঠান। তাঁকে বলেন, সামসু বিয়ে করেছে। শোন, সামসু এখন বেকার। আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আমাকে ১০ হাজার টাকা ধার দে। তোফায়েল বলেন, ৫ হাজারের বেশি দিতে পারব না। বঙ্গবন্ধু বলেন, তা-ই দে। শেষে তোফায়েলের কাছ থেকে আরও ৫ হাজার টাকা নিয়ে চলে আসেন সামসুল হুদা।

মিলিটারি একাডেমিতে এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এত দুঃখের মধ্যে, না খেয়ে..., গায়ে কাপড় নাই, কত অসুবিধার মধ্যে বাস করছে তারপরও লাখ লাখ লোক দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখার জন্য...’। তিনি প্রায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন,  ‘...সেই দুখী মানুষ দিনভর পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, পেটে খাবার নাই, বাসস্থান নাই...।’

আরেক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আপনার মাইনা দেয় ওই গরিব কৃষক; আপনার মাইনা দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়; আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ... ওদের সম্মান করে কথা বলবেন। ওরাই মালিক। সরকারি কর্মচারীকে বলব– মনে রখো, এ স্বাধীন দেশ; এ ব্রিটিশ কলোনি নয়, এ পাকিস্তানি কলোনি নয়। যে লোকটাকে দেখবা তাঁর চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজেরা কামাই করে খায়। একটা জিজ্ঞাসা করি আপনাদের কাছে, আমি তো আপনাদেরই একজন। আমাদের লেখাপড়া শিখাইছে কেডা? ডাক্তারি পাস করায় কে? ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করায় কে? বৈজ্ঞানিক করে কে? আফিসার করে কে? কার টাকায়? বাংলার দুখী জনগণের টাকায়। শিক্ষিত ভাইদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা– ওরা আপনাদের খরচ জুগিয়েছে শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়...। জুগিয়েছে, কারণ আপনি ওদের জন্য কাজ করবেন, সেবা করবেন। বিনিময়ে তাদের আপনি কী দিয়েছেন, কী ফেরত দিচ্ছেন, কতটুকু দিচ্ছেন…?’

নিছক বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করার জন্য এই লেখা নয়। গরিবের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি একজন মানুষও যদি থাকে, এই লেখা তার অন্বেষণ করে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে যাঁরা পরিচিত; কেন্দ্রীয় নেতা থেকে পাড়াগাঁয়ের কর্মী– সবার দিকে তাকিয়ে আমরা আজ প্রমাদ গুনি।

শুধু কি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক? ‘কমিউনিস্টরাও’ ফিরে গেছে সুবিধাবাদী নীতি মেনে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট অন্বেষণে। কেউ-ই রইল না আর গরিবের পাশে! শ্রমিক, দিনমজুর, গৃহকর্মীর ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর পক্ষে কথা বলার মতো একজন সংসদ সদস্যও আমরা খুঁজে পাই না। যে দেশে আজ বঙ্গবন্ধুর ভক্তের সংখ্যা হাতে গোনা যায় না; সে দেশেই উঁচুতলার লোকদের দেখতে আমাদের আকাশের দিকে তাকাতে হয়; হারিয়ে যায় নিচুতলার মানুষ ।  

ড. এন এন তরুণ: ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড; সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ
nntarun@gmail.com