
রমজানের পরের মাস অর্থাৎ হিজরি সনের ১০ম মাস হলো শাওয়াল। ‘শাওয়াল’ অর্থ উঁচু করা, উন্নতকরণ; পূর্ণতা, পাল্লা ভারী হওয়া, গৌরব করা, বিজয়ী হওয়া; প্রার্থনায় হস্ত উত্তোলন; দায়ভারমুক্ত ব্যক্তি; ক্রোধ প্রশমন ও নীরবতা পালন। এসব অর্থের প্রতিটির সঙ্গেই শাওয়ালের সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ মাসের আমল দ্বারা উন্নতি লাভ হয়; নেকির পাল্লা ভারী হয়; গৌরব অর্জন হয় ও সাফল্য আসে; ফরজ রোজা পালন শেষে নফল রোজার প্রতি মনোনিবেশ করে; আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জন করে; পরিপক্বতা ও স্থিতি লাভ করে। এসবই হলো শাওয়াল মাসের নামের যথার্থতা। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা ইনশিরাহ-এর ৭-৮ আয়াতে এরশাদ করেন: ‘যখন তুমি ফরজ দায়িত্ব সম্পন্ন করবে তখন উঠে দাঁড়াবে এবং তুমি নফলের মাধ্যমে তোমার রবের প্রতি অনুরাগী হবে।’
এ মাসের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ। এ মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে হজের। এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে ঈদের। এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সদকা ও জাকাতের। তাই এই মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত উর্বর ও উপযোগী। নফল রোজার মধ্যে অন্যতম শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা। পবিত্র রমজান মাসব্যাপী যাঁরা সিয়াম সাধনা করেছেন, তাঁদের জন্য শুভ সংবাদ হলো– শাওয়াল মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখলেই মিলবে সারাবছর রোজা রাখার সওয়াব। এ ছয়টি রোজা রাখা মোস্তাহাব। এর ফজিলত বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হাদিস শরিফে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা শাওয়াল মাসের ছয় দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি এই মাসে ছয় দিন রোজা রাখবে, আল্লাহতায়ালা তাকে প্রত্যেক সৃষ্ট জীবের সংখ্যার সমান নেকি দেবেন; সমপরিমাণ গুনাহ মুছে দেবেন এবং পরকালে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন।
অপর হাদিসে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসের সব ফরজ রোজা রাখল, অতঃপর শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারাবছরই রোজা রাখল। (সহিহ মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা শেষ করে ছয় দিন রোজা রাখবে, সেটা তার জন্য পুরো বছর রোজা রাখার সমতুল্য। (মুসনাদে আহমদ) হাদিসগুলোতে বিশেষ লক্ষণীয়, আলাদাভাবে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা কিংবা পুরো রমজানের রোজায় এক বছর নফল রোজার সওয়াব দেওয়া হবে না, বরং পুরো রমজান মাস রোজা রাখার পরে শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোজা রাখলে তবেই পূর্ণ এক বছর নফল রোজা রাখার সওয়াব লাভ হবে।
বস্তুত হাদিসে পবিত্র কোরআনেরই একটি আয়াতের বক্তব্য বিবৃত হয়েছে। সুরা আল-আনআম এর ১৬০ আয়াতে এরশাদ হয়েছে: ‘যে কেউ কোনো নেক আমল করবে, তাকে তার ১০ গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে। সুতরাং রমজানের এক মাসের ১০ গুণ হলো ১০ মাস আর শাওয়াল মাসের ছয় দিনের ১০ গুণ হলো ৬০ দিন বা দুই মাস।
অর্থাৎ পূর্ণ এক বছরের নফল রোজার সওয়াব লাভের জন্য রমজানের রোজা রাখার পরে শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখার শর্ত থাকলেও যদি কেউ কোনো কারণে রমজানের পূর্ণ মাস রাখতে না পারেন, তাহলে শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখা যাবে না, তেমনটি নয়। সে ক্ষেত্রে পূর্ণ এক বছরের নফল রোজার সওয়াব না পেলেও নফল রোজা পালনের সীমাহীন নেকি তিনি পাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কেননা, নবীজি (স.) বেশি বেশি নফল রোজা নিজে তো রাখতেনই, সাহাবিদেরও উৎসাহিত করতেন। নফল রোজার মধ্যে আছে সাপ্তাহিক দুই রোজা সোমবার ও বৃহস্পতিবার, মাসিক তিন রোজা আইয়ামে বিজ তথা চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা; মহররম ও আশুরার রোজা; শাবান মাসের রোজা; শাওয়ালের ছয় রোজা; জিলহজ মাসের প্রথম দশকের রোজা; বিশেষ করে ৯ তারিখের রোজার বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করতেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)।
শাওয়াল মাসের যে কোনো সময় এ ছয়টি রোজা পালন করা যায়। ধারাবাহিকভাবে বা মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়েও আদায় করা যায়। রমজানের ছুটে যাওয়া কাজা রোজা পরবর্তী রমজান মাস আসার আগে যে কোনো সময় আদায় করা যাবে। ফরজ রোজা কাজা করার আগে নফল রোজা রাখা যাবে। তবে সম্ভব হলে আগে ফরজ রোজার কাজা আদায় করাই উত্তম। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ)
হাদিস শরিফে বর্ণিত, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমার ওপর রমজানের যে কাজা রোজা বাকি থাকত, তা পরবর্তী শাবান ব্যতীত আমি আদায় করতে পারতাম না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হাদিসমতে, শাওয়াল মাসে বিয়েশাদি সুন্নত, যেরূপ শুক্রবার এবং জামে মসজিদ ও বড় মজলিশে আকদ অনুষ্ঠিত হওয়া সুন্নত। কারণ হজরত আয়েশার (রা.) বিয়ে শাওয়াল মাসের শুক্রবারে মসজিদে নববিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। (সহিহ মুসলিম)
শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখা রমজানের রোজা কবুল হওয়ারও পরিচায়ক। আল্লাহতায়ালা কোনো বান্দার আমল কবুল করলে, তাকে অনুরূপ আরও আমল করার তৌফিক দান করেন। নেক আমলের প্রতিদানের একটি রূপ হলো আবার আরও নেক আমল করার সৌভাগ্য অর্জন করা। তাই নামাজ, রোজা, তেলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি বাকি ১১ মাসও বজায় রাখতে হবে।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
মন্তব্য করুন