
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার জায়গা হলো এ দেশের বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এই জনমিতিক সুফল পেতে হলে অনতিবিলম্বে তাদের যুগের চাহিদা পূরণে সক্ষম অভিযোজন দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। ব্রুকিংস রিপোর্টে (২০১৬) দেখা যায়, ১০২টি দেশের মধ্যে ৭৬টি দেশের শিক্ষাক্রমে সুনির্দিষ্টভাবে দক্ষতাভিত্তিক যোগ্যতাকে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ৫১টি দেশের শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণরূপে রূপান্তরমূলক দক্ষতাভিত্তিক করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও সম্প্রতি প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত একই উদ্দেশ্য অর্জনের মাধ্যমে একটি রূপান্তরমূলক যোগ্যতা ও সৃজনশীলতাসম্পন্ন জাতি তৈরির লক্ষ্য নিয়ে একটি নিরবচ্ছিন্ন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ প্রণয়ন করেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন শেখানো প্রক্রিয়ার চর্চা এবং শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ থাকবে না; ছড়িয়ে যাবে শিক্ষার্থীর প্রতিটি কাজ ও অভিজ্ঞতার মাঝে। শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষায় থেকেই জীবিকাসংশ্লিষ্ট দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাবে।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ভবিষ্যৎ উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখা শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে ২০২৭ সালে। এই শিক্ষাক্রমের আলোকে যে নতুন প্রজন্ম সামনের পৃথিবীর জন্য ভিন্নভাবে প্রস্তুত হয়ে এসে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে এবং বর্তমানে যে শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদচারণা করছে, তাদের ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও রূপান্তরিত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলোতে বিশেষ জোর দিতে হবে।
প্রথমত, উচ্চশিক্ষায় ভর্তি বা প্রবেশগম্যতা। উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের দ্বার হতে হবে উন্মুক্ত। এ ক্ষেত্রে বয়সের বাধা দূর করতে হবে। মুখস্থনির্ভর ভর্তি পরীক্ষা থেকে বের হয়ে একাধিক উৎসভিত্তিক প্রক্রিয়া যেমন অ্যাপ্টিটিউড/ক্রাইটেরিয়া রেফারেন্স টেস্ট প্রবর্তন, পূর্ব পারদর্শিতার রেকর্ড, রেফারেন্স লেটার ইত্যাদির ভিত্তিতে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত দেশগুলো তাদের উচ্চশিক্ষাকে কতটা নমনীয় করেছে তার একটি বড় উদাহরণ হলো বাংলাদেশের স্কুলের শিক্ষার্থীরা যখন আন্তর্জাতিক গণিত/বিজ্ঞান/ভাষা অলিম্পিয়াডে ভালো ফল করে, তখন তাদের সরাসরি স্কলারশিপ দিয়ে ব্যাচেলর প্রোগ্রামে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয়। আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা কিন্তু এখনও এই নমনীয়তার জন্য প্রস্তুত নয়।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাক্রমে রূপান্তর। প্রতিটি অনুষদের শিক্ষাক্রম হতে হবে নমনীয়, আন্তঃবিষয়ক, মডিউলার, কো-ডিজাইন্ড। শিক্ষাক্রম প্রণয়নে আন্তঃঅনুষদ এবং আন্তঃবিভাগ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সমন্বয় ও আদান-প্রদান প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, মানবিকের একজন শিক্ষার্থীর বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে যদি মৌলিক বিজ্ঞানের পদার্থের শব্দ বিষয়ে কোর্স করার প্রয়োজন হয়, সেই সুযোগ শিক্ষার্থীকে দিতে হবে। তৃতীয়ত, শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় রূপান্তর। শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া হতে হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক, যাতে ব্যক্তিনির্ভর/ পারসনালাইজড, স্বপ্রণোদিত, ডিজিটাল সংযোগভিত্তিক শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। হাইব্রিড উপায়ে প্রফেশনাল শিখন দল ও মেন্টর দল তৈরি করে শিখন প্রক্রিয়া পরিচালনা জরুরি। চতুর্থত, শিখন উপকরণে রূপান্তর: শিখন উপকরণ শুধু বই নয়; পাশাপাশি রিসার্চ জার্নাল, পরিবেশের যে কোনো উপাদানই শিখন উপকরণ হতে পারে, সেভাবে উপকরণের ধারণায় পরিবর্তন আনা এবং শিখনচর্চায় তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পঞ্চম বিষয়, শিখন মূল্যায়নের ধারণায় রূপান্তর: গতানুগতিক মুখস্থনির্ভর পেপার-পেন্সিলভিত্তিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার চর্চা কমিয়ে শিখন মূল্যায়নে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা পরিমাপের উদ্দেশ্যে মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। গ্রেড/ডিভিশনের পরিবর্তে প্রজেক্ট/অ্যাসাইনমেন্ট/মিনি রিসার্চের মাধ্যমে শিখনকালীন ও গাঠনিক মূল্যায়নের চর্চা বাড়াতে হবে। ষষ্ঠত, গবেষণা, প্রকাশনা ও ডিজিটাল নলেজ হাব স্থাপন: বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক গবেষণার মান নিয়ন্ত্রণ, সামষ্টিক উপায়ে এসব গবেষণার ফলকে কাজে লাগিয়ে পলিসি অ্যাডভোকেসি করা জরুরি। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশনার মাধ্যমে নলেজ শেয়ার এবং নলেজ হাব প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক হাবগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি প্রয়োজন।
সপ্তম, অটোমেশন: বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক প্রশাসনিক, একাডেমিক ব্যবস্থাপনার অটোমেশন এখন সময়ের দাবি। প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে, তবে সমন্বিত অ্যাপ্রোচ দরকার। অনেক ক্ষেত্রেই ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা প্রয়োজন। তা ছাড়া পুরো একাডেমিক কার্যক্রম লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। অষ্টম, বিশ্ববিদ্যালয়-ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতা: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মক্ষেত্রের অংশীজনের অংশগ্রহণ ছাড়া নতুন অ্যাপ্রোচের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই সব বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়-ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতার চর্চাকে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে চর্চায় আনতে হবে।
নবম, শিক্ষক উন্নয়ন । নতুন যুগের চাহিদা পূরণ করতে হলে দক্ষ, যোগ্য এবং সৃজনশীল শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বর্তমানে শিক্ষকদের মান উন্নয়নে বেশকিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ চালু আছে (যেমন বঙ্গবন্ধু স্কলারশিপ)। তেমনি রিসার্চ/পাবলিকেশন/কনফারেন্স অ্যাওয়ার্ড বাড়ানো প্রয়োজন। পৃথিবীতে শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে উন্নতির শিখরে পৌঁছা দেশগুলো (ভুটান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, জাপান ইত্যাদি) চাকরিতে শিক্ষকদের সর্বাধিক বেতন কাঠামো ও সামাজিক মর্যাদা প্রণয়ন করেছে, যাতে মেধাবীরা এই পেশায় আকৃষ্ট হয়। কাজেই অন্য পেশার তুলনায় মর্যাদার জায়গাটি নিয়ে ভাবতে হবে। শুরু থেকে অবিরাম পেশাগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং বিষয়জ্ঞানের পাশাপাশি নিয়োগের পরপরই শিখন বিজ্ঞানের ওপর ওরিয়েন্টেশন খুবই জরুরি। নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়াতে একাডেমিক অ্যাচিভমেন্ট ক্রাইটেরিয়াকে আরও বেশি জোরদার করা দরকার।
সর্বশেষ, শিক্ষার্থী অধিকার। সব পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে শিক্ষার্থী। স্বাস্থ্য বীমা, শিক্ষা বীমা, শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক অ্যাসেসমেন্ট প্রভৃতি চালুর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্যও রিসার্চ/পাবলিকেশন/কনফারেন্স অ্যাওয়ার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে জব মার্কেটে প্রবেশের প্রস্তুতি হিসেবে সহযোগিতা পায় সে সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভাষা, ধর্ম, জেন্ডার, প্রতিবন্ধিতাভেদে বৈচিত্র্য অনুযায়ী সাম্য নিশ্চিত করার জন্য ডাইভারসিটি সাপোর্ট সেন্টার স্থাপন প্রয়োজন।
বৈশ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ যতই মধ্যম আয়ের দেশের দিকে উত্তীর্ণ হবে, সে অনুপাতে শিক্ষা খাতে জিডিপির বরাদ্দ ২ থেকে ৬ শতাংশে উত্তীর্ণ করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের নিজস্ব উৎস থেকে বাজেট ব্যয় বহনের সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নয়, বরং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের সম্পদ এবং বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করে একটি ভবিষ্যৎমুখী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে নিয়োজিত হতে হবে। এই রূপান্তরে আইন বা নীতিমালা পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকেও দিকনির্দেশনার প্রয়োজন হতে পারে।
ড. এম তারিক আহসান: অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি
মন্তব্য করুন