প্রথম জীবনের স্মৃতি
আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫৯ সালে। অজস্র স্মৃতি মনে পড়ে। শুরু থেকেইে আনিসুজ্জামানের ভাবনা ও কাজে গভীর চিন্তার ছাপ দেখে মুগ্ধ হতাম। পরিচয়ের পর থেকে যত সময় কাটিয়েছি, স্বাভাবিকভাবে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ক্রমশ গাঢ়, গাঢ়তর হয়েছে।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে, ওটা বিশেষ। আমাদের তখন নতুন বিয়ে হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন কারও না কারও বাড়িতে আমরা নিমন্ত্রিত হচ্ছি। বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যেত। তখন চলাচলের জন্য রিকশা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু আমার শ্বশুর-শাশুড়ি স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত হতেন। আনিসুজ্জামান আমাকে বলেছিল, ‘বাসায় ফিরে এসে প্রতিদিন সবার আগে আমরা বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াব। কেমন? আমরা যে বাসায় এসেছি তা জানানোর জন্য।’ আমি বলেছিলাম, ‘বেশ তো, অসুবিধা কী।’ আমরা এসে বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াতাম। আমার শ্বশুর এ টি এম মোয়াজ্জেম, শাশুড়ি সৈয়দা খাতুন। আমাদের তাঁরা বকতেন, কিন্তু তা আমাদের গায়ে লাগত না। শ্বশুর ছিলেন নামকরা হোমিও চিকিৎসক। তাঁর চিকিৎসায় আমিও অনেক উপকৃত হয়েছি। তো আনিসুজ্জামানকে বাবা বলতেন, ‘এত পড়াশোনর কী মূল্য, ডক্টরেট করার কী মূল্য, যদি সময়জ্ঞানই না থাকে? এত রাত্রি করে নতুন বউকে নিয়ে ফিরছ রিকশায় চড়ে। ক’টা বাজে এখন?’ আনিসুজ্জামান চুপ করে শুনত, আমিও চুপ করে থাকতাম। আমার বাবা-মা আমাদের সব ভাইবোনকে বলে দিয়েছিলেন, মুরুব্বিদের কথার পরে কথা বলতে নেই। ছয়-সাত দিন টানা নিমন্ত্রণে গিয়ে ফিরতে রাত হওয়ার পর আমি বললাম, ‘দেখো, পরপর এতগুলো দিন আমরা গেলাম। আজ গেলে বাবা নিশ্চয়ই আবার রাগ করবেন। আজকে আমি আর না যাই। তুমি যাও।’ তখন আনিসুজ্জামান বলল, ‘দেখো, আব্বা-আম্মার বয়স হয়েছে। ওনাদের যা কর্তব্য, ওনারা করছেন। আমাদের বকছেন। আমাদের যা কর্তব্য, আমরা চুপ করে থাকব, সেইসঙ্গে আমাদের যে কাজগুলো করতে হবে সেগুলোও আমরা করে যাব। তুমি শুধু কোনো উত্তর কোরো না।’ আমি বললাম, ‘না, উত্তর করাটা আমি শিখিনি।’ আনিসুজ্জামান এই যে মেলবন্ধনটা করিয়ে দিল আমার শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে, তাঁদের চরিত্র ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের সাথে, তাতে সবটা সহজ হলো। আমি অন্তর দিয়ে গ্রহণ করলাম। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনই অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁদের যে ভালোবাসা, মায়া-মমতা আমি পেয়েছি, তা দুর্লভ।
আনিসুজ্জামানের মনন
আনিসুজ্জামান মানুষের ভীষণ আপন ছিলেন। একটা কারণ হয়তো তিনি নিজেও মানুষ প্রিয়, বন্ধুবৎসল ছিলেন। সব সময় সবার সাহায্যে এগিয়ে যেতেন। কারও অনুরোধ ফেলতে পারতেন না। মানুষের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেন। আর নিমন্ত্রণ পেতেনও প্রচুর। এমনও দিন গেছে, মাসে আমাদের শুধু দুটো দিন কোনো নিমন্ত্রণ ছিল না। আমি বলতাম, ‘তুমি যে প্রতিটা দাওয়াত এভাবে রক্ষা করছ, তোমার তো কিছু নিজের জন্য সময় দরকার। লেখার জন্য সময় দরকার। তার কী হবে?’ আনিসুজ্জামান হাসত। ‘মানুষগুলো আশা করে এসেছে, অনুরোধ করেছে। যাওয়াতে কী যে খুশি হয়েছে। এটা আমি উপেক্ষা করি কী করে বলো?’
হয়তো দেশের বাইরে যেতে হবে, সেদিনও নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এসে, ব্যাগ গোছগাছ করে প্রায় নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, সকালে রওনা হয়েছে।
ব্যক্তি আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান আমেরিকা থেকে আসার পরে আমরা নতুন বাসায় গেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে। যেহেতু আমরা শ্বশুরবাড়িতে থাকতাম, রাত করে ফিরতাম, লোকজন তেমন আসতেন না। আমরাই যেতাম বেশি। কিন্তু নতুন বাসায় আমাদের বন্ধুবান্ধব, স্বজনদের আসার পথ প্রশস্ত হলো। মানুষ আমাদের ভালোবেসেছে। তাঁরা আপন জ্ঞান করে অবাধে আসতেন। আড্ডা হতো, আলাপ হতো। মাঝে মাঝে আমি সামলে উঠতে পারিনি তা সত্যি। কিন্তু আনিসুজ্জামানের সহায়তায় পরে ঠিক সামলে নিতাম। আর সেই সময়গুলো, তাঁকে একটু একটু করে আরও গভীরভাবে চেনার মুহূর্তগুলোয় আমি বুঝতে পারলাম, আনিসুজ্জামান গৃহমুখী নয়। সে বাহিরমুখী।
সে দেশ, মানুষ, তাঁর ছাত্রছাত্রী, সংস্কৃতিবোধ, আদর্শ নিয়ে গড়া তাঁর জগৎকে গভীরভাবে ভালোবাসত। ধীরে ধীরে তার এই বাহিরমুখিতা এত বৃদ্ধি পেল যে একেক সময় আমার মন খানিকটা খারাপ হয়ে ওঠেনি তা নয়। কিন্তু একসময় ভাবলাম, কোনো ঝরনাধারাকে যদি বাধা দেওয়া হয়, সে চারিদিকে ছিটকে পড়ে। আমার বাধা দেওয়া একেবারে উচিত না। যদি পারি, আমি ওর সহযোগিতাই করে যাব বাকিটা জীবন। আমার মনে হয় আমি তা করতেও পেরেছিলাম।
দৈনন্দিন জীবন
ষাটের দশকের মাঝামাঝি আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক বাসায় গেলাম (নীলক্ষেতের ২৪ নম্বর বিল্ডিং) তখন আমাদের দিন শুরু হতো দুই মনীষীর আগমনে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক (পরবর্তী সময়ে জাতীয় অধ্যাপক) আমাদের বাসায় আসতেন, সকাল ৭টার সময়। রাজ্জাক স্যার আমাদের দু’জনকেই অত্যন্ত স্নেহ করতেন। এসে বসেই ওনার স্নেহের কণ্ঠে আমাকে বলতেন, ‘বেবী, আমারে এক কাপ চা দাও।’ আমি তাঁকে চা দিতাম। তখন আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলে কাজ করি। চা দিয়ে, তৈরি হয়ে আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে বসতাম খাবার টেবিলে। তিনি নিজে খুব ভালো রান্না করতে পারতেন। আমি রান্না বেশি জানতাম না। তিনি আমাকে অনেক শিখিয়েছেন। মনে আছে, একবার ইলিশ মাছ কেটে ভালো করে ধুয়ে মসলা মাখিয়ে রান্না করেছিলাম। তিনি খেতে বসে বললেন, ‘বেবী এটা করসো কী। তুমি ইলিশ মাছ কখনও রানসো?’ আমি বললাম, ‘না স্যার।’ তিনি বললেন, ‘কাইটা আবার ধুইসো?’ আমি বললাম, ‘জি। আমার মা তো আমাকে শিখিয়েছেন মাছ কেটে ভালো করে ধুতে হয়।’ তিনি বললেন, ‘তোমার আম্মাা সেই কথা অন্য মাছগুলার ব্যাপারে কইছিল। ইলিশ মাছের ব্যাপারে কয় নাই। ইলিশ মাছ আস্ত ধুয়ে নিয়ে কাইটা আর ধুবা না। প্রয়োজন হলে একটা কাপড় দিয়া মুইছা নিবা।’ ইলিশ মাছ কেটে আর না ধুয়ে রান্না করে পার্থক্যটা পড়ে নিজেও বুজেছি।
এ প্রসঙ্গে বলি, আনিসুজ্জামান কখনোই খুব বেশি খেতো না। আমরা সবাই খুব পরিমিত খেতাম। স্যার একদিন বললেন, ‘খালি তোমারেই শিখামু? আনিসুজ্জামানরেও লইয়া যাই বাজারে।’ আমি বললাম, ‘দেখেন স্যার, যদি কিছু করতে পারেন।’ অতঃপর আনিসুজ্জামান গেল ওনার সঙ্গে বাজারে। দু-একবার যাওয়ার পর একদিন রাজ্জাক স্যার বললেন, ‘নাহ, ওরে দিয়া হইবো না। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘কী হয়েছে স্যার?’ বললেন, ‘আরে ও কসাইরে জিজ্ঞাস করব গরুটা কেমন, তা না। কসাইগোরে জিজ্ঞাস করে, আপনার ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে? নাহ, খালি বাজারের ব্যাগ টানাটানির লাইগা ওরে আমার নিয়া যাওনের দরকার নাই।’
সকালের দ্বিতীয় অতিথি হতেন মুনীর চৌধুরী (শহীদ বুদ্ধিজীবী), আসতেন সাড়ে ৭টার সময়। সেকেন্ড বেলটা বাজতেই আমরা বুঝতাম মুনীর ভাই এসেছেন। আনিসুজ্জামান তখন তাড়াতাড়ি তৈরি হতে যেত। মুনীর ভাই ঠিক যেন আমার স্নেহশীল বড় ভাইটি ছিলেন। আমি তখন কাজে বেরিয়ে যাব, নাশতায় বসার আগে তাড়াহুড়ায় গোছগাছ করছি। তা দেখে তিনি আমার রুটিতে মাখন লাগিয়ে দিতেন। তখন রাজ্জাক স্যারও থাকতেন। মুনীর ভাইয়ের সঙ্গও খুব পছন্দ করতেন রাজ্জাক স্যার। আমরা একসঙ্গে চা খেতাম। নাশতা শেষে মুনীর ভাই আমাকে গাড়িতে করে ব্রিটিশ কাউন্সিলে পৌঁছে দিতেন। এখন মনটা শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি শহীদ হওয়ার পর অনেক দিন আমি মুনীর ভাইকে নিয়ে কোনো কথাই বলতে পারতাম না। লিলি ভাবিকে জড়িয়ে কতদিন কেঁদেছি। পরবর্তী সময়ে অনেক দিন আমি যখন কোনো অনুষ্ঠানে প্রথম সারিতে আনিসুজ্জামানের সঙ্গে গিয়ে বসতাম, তখন আমার খুব অস্বস্তি হতো; সব সময় আমার মনে হতো, আমি এখানে আনিসুজ্জামানের পাশে বসে, কিন্তু মুনীর ভাই, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা সাহেবের স্ত্রীসহ আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কী অপরাধ করেছিলেন? ওরা কী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, আর আমি কীভাবে আছি– আমার মনে এখনও বেদনার সৃষ্টি করে।
আনিসুজ্জামান আত্মমগ্ন স্বভাবের ছিল, কিন্তু যথাসম্ভব সাহায্য করত আমাকে। আমরা আমাদের জীবনে স্বজন, বন্ধুদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছি। একবার আবদুর রাজ্জাক স্যার শারীরিক চেকআপ করতে সিঙ্গাপুর যাবেন, তো লিটুকে বললেন, ‘আমি চেকআপ করব, আনিসুজ্জামানরেও চেকআপ করাব। তুমি সব ব্যবস্থা কইরা রাখো।’ আবুল খায়ের লিটু, বেঙ্গল চেয়ারম্যান, ওর ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারব না। লিটু, লুভা, মহুয়া– ভাই বোন সবাই– ওরা যে আমাদের কী ভালোবাসে, আমি এক কথায় বলে শেষ করতে পারব না।
আনিসুজ্জামানের বিশেষ দিক
আনিসুজ্জামান আদর্শের জায়গা থেকে দুটো ব্যাপার খুব মানত। এক, কারও কাছ থেকে টাকা ধার নিলে সে যত দ্রুত পারে ফেরত দিতে চেষ্টা করত। কখনও এমনও হয়েছে, আমার কাছ থেকে কুড়ি টাকা নিয়েছে। এসেই ফেরত দিত। আমি বলতাম, ‘কেন এমন করছ? তোমারই টাকা।’ আনিসুজ্জামান বলত, ‘না। এটা আমি ধার করেছি। তোমার প্রাপ্য।’ দুই, আনিসুজ্জামান বলত, ‘কারও কাছে যদি একটুখানি উপকারও কখনও পেয়ে থাকো, আজীবন মনে রাখবে।’ ওর এই কথাগুলো আমি মেনেছি, আমাদের ছেলেমেয়েরাও মেনেছে। আরেকটা বিষয় মান্য করায় ও অতুলনীয় ছিল– সময়জ্ঞান। তাঁর এই দুই গুণ দ্বারা আমরাও সবাই প্রভাবিত।
বাসায় ওর ছাত্রছাত্রীরা আসত। প্রথম দিকে ওদের সঙ্গে আমি ততটা স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। আনিসুজ্জামান বলল, ‘দেখো, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে ওদের কাছ থেকে একটা দূরত্ব মেনে চলতে হয়। কিন্তু যখন বাসায় আসে, তখন ওরা ভিন্ন মানুষ। তখন যদি ওদের আমরা আরও কাছে টেনে না নিই, আমরা তো ওদের আপন করতে পারব না। ওরা যখন আসবে, তুমি তোমার মতো কথা বোলো, ওদের আপন করে নিও।’ এরপর আমি ওদের আরও আপন করে নিতে শুরু করি। এবং আজ পর্যন্ত ওর অনেক ছাত্রের সঙ্গে যোগাযোগটা অটুট আছে। তারা আজও আমাদের ভালোবাসছে। বারবার কষ্ট এসেছে, তবুও, মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার দিক থেকে আমরা ভীষণ সৌভাগ্যবান। এ কথা বলতেই পারি। আনিসুজ্জামান ছিল ভীষণ চাপা স্বভাবের। যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর যোগ দেওয়ার কথা ছিল, দেখেশুনে আসবে বলে ও রওনা হলো, ১৯৬৯ সালের ৩ জুন। কথা ছিল ও আগে দেখে আসবে, আমি, আমার বড় মেয়ে রুচি–  আমরা পরে যাব। সেদিন ঢাকায় অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই ট্রেনে কাটা পড়লেন। সেদিন আনিসুজ্জামানও চট্টগ্রাম যেতে পথে কুমিল্লার কাছে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ল। তীব্র আঘাত পেল শরীরে। হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান তখন সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি আনিসুজ্জামানসহ আরও যারা আহত হয়েছেন তাদের কুমিল্লার সামরিক হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেখানে আনিসুজ্জামানকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধপত্র দেওয়া হলো। পরে ঢাকায় চিকিৎসার সময় এক্স-রে করে দেখা গেল, ওর কলারবোন ভেঙেছে। কুমিল্লা সিএমএইচে কলারবোনের নিচ থেকে দেখা হয়েছিল বলে ধরা পড়েনি। ওর প্রচণ্ড সহ্যশক্তি ছিল। এই দুর্ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাসায় দেখতে এসেছিলেন, তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়ে।
১৯৭১
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে চৌষট্টি-পঁয়ষট্টি সালে পোস্ট ডক্টরেট করার সময় ব্যারি মরিসন নামের একজন গবেষকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আনিসুজ্জামানের। ভদ্রলোক কানাডীয়। দেশ স্বাধীনের আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন, আমাদের বাসায় প্রায় তিন মাস ছিলেন। বিশেষ কিছু নিয়ে গবেষণা করছিলেন সেই সময়ে। ফিরে যাওয়ার পর, এক পর্যায়ে যখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, সারা বিশ্বে খবর প্রকাশ হচ্ছে, তখন ভদ্রলোক আনিসুজ্জামানের জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে, থাকার জায়গা ঠিক করে চিঠি পাঠালেন। আমরা তখন শরণার্থী হয়ে কলকাতাতে। ব্যারি লিখেছিলেন, ‘তুমি সপরিবারে চলে এসো। এখানে সব ব্যবস্থা করা আছে।’ আনিসুজ্জামান আমাকে বললেন, ‘বেবী, তিনি এমন একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু দেশের এ অবস্থায় আমি যেতে চাই না।’ আমি বললাম, ‘আমিও যেতে চাই না। আমরা কেন এসকেপিস্ট হবো?’ আমরা রয়ে গেলাম। আরও কত অজস্র স্মৃতি, সেসব ‘কাল নিরবধি’, ‘বিপুলা পৃথিবী’তে আনিসুজ্জামান যত্ন করে লিখেছে।
লেখালিখি
লেখার ব্যাপারে আনিসুজ্জামানের সততার তুলনা ছিল না। স্বভাবগতভাবেই যে কোনো বিষয়ের অত্যন্ত গভীরে প্রবেশ করত। গভীর মনঃসংযোগসহ লিখত। আমার আক্ষেপ জাগে, লেখার জন্য যদি ও আরও বেশি সময় পেত, ভীষণ ভালো হতো। ও যখন লিখত, আমি সাধ্যমতো নীরবতা বজায় রাখতাম। ওর জন্য কোনো কাজ রাখতাম না। যখন লিখছে, কখনও হয়তো পাশে দাঁড়িয়েছি। দেখলাম ও তাকাচ্ছে না, চলে এসেছি। ওর লেখার সময়টা আমিও ভীষণ উপভোগ করতাম। লেখা সবার আগে আমি পড়তাম। মাঝে মাঝে পড়তে পারতাম না, পরে পড়তাম। তখনও কোনো সংশোধনের কথা বললে ও সংশোধনও করে নিত।
আপনারা আগেই জেনেছেন, আনিসুজ্জামান কারও অনুরোধ ফেলতে পারত না। কত সভা-বৈঠকে যে ও বক্তব্য রেখেছে তার কোনো হিসেব নেই। অজস্র। ওর অমূল্য কথামালার কতটাই-বা সংগ্রহে রাখা গেছে? আমাদের বদরুদ্দীন উমর ভাই বলতেন, ‘বেবী, আনিসুজ্জামান যে এত মিটিং করে, বক্তব্য রাখে, ওর কথাগুলো কি সংরক্ষণ করে, বাসায় এসে লিখে রাখে? এগুলো তো হারিয়ে যাচ্ছে। ও তো বসে বসে এই সময়ে কত কী লিখতে পারত।’ আমি বললাম, ‘কী করব ভাই। এত আগে থেকে ওর সব ঠিক করা থাকে, ওদের জন্য সময় ভাগ করা থাকে যে কিচ্ছু বলা যায় না।’ উমর ভাই বলেছিলেন, ‘ও বুঝতে পারছে না।’
সত্যিই, ওর কথাগুলো লেখায় রূপান্তর করে আরও বেশি সংরক্ষণ করতে পারলে আমি মনে করি, দেশের, মানুষের কল্যাণ বয়ে আনত। আনিসুজ্জামান প্রচুর বইয়ের ভূমিকা লিখেছে। এত বেশি সংখ্যক বইয়ের ভূমিকা লিখেছে যে সেসব জড়ো করলেও আরও বই হয়ে যাবে। কাছের মানুষের বড় বড় বই সম্পাদনা করেছেন, বানান শুদ্ধ করে দিয়েছেন। এবং নিজের লেখার সময় থেকে কেটে নিয়ে, দায়িত্বজ্ঞান মনে করে কাজগুলো করেছে। আমি সযত্নে যা লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করেছি তা হলো, ওর যা ভালো লাগে, তা যেন করে যেতে পারে।
ওর লেখক জীবনে বারবার অবরুদ্ধ সময়ে এসেছে। সেই সময়গুলো আমরা ধৈর্যের সঙ্গে অতিক্রম করেছি। একটি সময় নিয়ে আমার মনে বিশেষ কষ্ট জমা আছে। ষাটের দশকের শেষভাগে, সাতষট্টি বা উনসত্তর সালে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার জন্য ভারতবর্ষের ভাষা বিষয়ে একটা নিবন্ধ লেখার আনিসুজ্জামানের কাছে অনুরোধপত্র আসে। আমি যে কী গর্বিত হয়েছিলাম। আমার বাবা (সাংবাদিক আব্দুল ওয়াহাব) এত খুশি হয়েছিলেন যে বলার নয়। বলেছিলেন, ‘দেখো, বিশ্বের মাঝে যারা একটা বিষয়ে অথরিটি, শুধু তাঁরাই এখানে লেখার আমন্ত্রণ পায়।’ বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য ভারত থেকে আনিসুজ্জামানের কিছু বই আনানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আর তার প্রভাবে, পরবর্তীকালে শুধু বই কেন, প্রায় কিছুরই আনা-নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। একাত্তর সালের যে সময়ে নিবন্ধ পাঠানোর শেষ দিন ছিল, সেই সময় দেশে যুদ্ধ চলছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার আমাদের ছেড়ে দিতে হলো। আমরা কুণ্ডেশ্বরী চলে গেলাম, সেখানে থাকতে শুরু করলাম। বাধ্য হয়ে ও সমস্ত ব্যাখ্যা করে অপারগতা জানিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে দিল। চিঠিটা পরে ওরা কোথাও ছেপেছিল, কিন্তু আমাদের কাছে এর কোনো কপি নেই।
আনিসুজ্জামানের ‘কাল নিরবধি’ জনকণ্ঠে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছিল। আর ‘বিপুলা পৃথিবী’ প্রথম আলোতে। লেখাটা শেষ করায় একটা গতি আনতে চাইছিলেন মতিউর রহমান। আনিসুজ্জামানের সামাজিক আর আনুষঙ্গিক ব্যস্ততা দেখে মতি ভাই একদিন বললেন, ‘ভাবি, স্যারকে দিয়ে এভাবে হবে না। ওনাকে আটকাতে হবে।’ তারপর এক হোটেলে ‘আটকানোর’ ব্যবস্থা হলো। চার দিনের জন্য একটা রুম ভাড়া করে লেখার সব উপকরণ উপস্থিত করা হলো। এই করে লেখা শেষ হলো ‘বিপুলা পৃথিবী।’ পরবর্তী সময়ে আমারও একটি আত্মজৈবনিক লেখা প্রকাশের উদ্যোগ নিল অন্যপ্রকাশ। আমার ছেলে বলল,  ‘আব্বার বইয়ের নামের অনুকরণে এর নাম রাখো ‘আমার বিপুলা পৃথিবী।’ তাই রাখা হলো। পুরোনো বাংলা গদ্য নিয়ে আনিসুজ্জামানের আরও কাজ করার ইচ্ছে ছিল। এটা ওর বিষয়গুলোর একটা ছিল। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে উঠল না।