
গোটা বিশ্ব থেকে মুসলমানদের পবিত্র হজের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে চলতি বছরের হজ ফ্লাইট ২১ মে থেকে শুরু হওয়ার কথা। হজ যেহেতু শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত, সে জন্য এর প্রস্তুতি আগে থেকেই নিতে হয়। হজ করার জন্য শারীরিক কিংবা আর্থিকভাবে তো বটেই; মানসিকভাবেও বান্দাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। কারণ, সৎকর্মশীলদের জন্য সৎ কাজ ও সত্য অনুসরণের সুবর্ণ সুযোগ এবং আল্লাহকে স্মরণকারী ও ধার্মিকদের চূড়ান্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা হলো পবিত্র হজ। ইবাদতের পরিবেশ, ইসলামের প্রাথমিক যুগের স্মৃতি, আত্মত্যাগী মনোভাব, মুক্তি ও সম্মানের বিষয় প্রত্যেক হজযাত্রীর হৃদয়কে আলোকিত করে তোলে। এ সবকিছুই সচেতন হজযাত্রীর মনের খোরাক। হজ পালন উপলক্ষে মক্কায় সমাগত মানুষ সব সংকীর্ণতা, পঙ্কিলতা ও ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকে। তাঁরা অল্প সময়ের জন্য বাহ্যিক আবরণগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তাঁদের ইহরামের সাদা পোশাক, মনের পবিত্রতা, আন্তরিকতা ও একতা শরীর এবং অন্তরের ওপর জয়ী হয়। প্রস্ফুটিত হয় সত্য জ্ঞান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ব; একই সঙ্গে স্পষ্ট হয় খোদায়ি পথনির্দেশনা।
প্রস্তুতির মধ্যে হজের সব বিষয় জানাও অন্তর্ভুক্ত। হজের আভিধানিক অর্থ সংকল্প; কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করা। শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট তারিখে মক্কার কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ (দৌড়ানো), মিনায় অবস্থান প্রভৃতি কাজ যেভাবে হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেইভাবে সম্পাদন করার নাম হজ। এটি হলো ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের পঞ্চম।
হজের কিছু মৌলিক বিষয় হাজিদের জানা আবশ্যক– ১. হজের নিয়ত, ২. ইহরাম বাঁধা, ৩. আরাফাতের মাঠে অবস্থান, ৪. মুযদালিফায় রাতযাপন, ৫. মিনায় অবস্থান এবং শয়তানের প্রতি কংকর নিক্ষেপ, ৬. কাবাঘর তাওয়াফ, ৭. হাজরে আসওয়াদে (কালো পাথর) চুমো দেওয়া, ৮. সাফা-মারওয়ায় সাঈকরণ, ৯. কোরবানি করা, ১০. মাথার চুল মুণ্ডন বা কর্তন।
হজ নিছক কোনো ভ্রমণ নয়। এটি বিশ্ব-মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তম সমাবেশ। এটা খোদায়ি অনুশীলন এবং প্রকৃত মানুষ হওয়ার তালিম গ্রহণের স্থান; মিথ্যা আমিত্ব ও শিরকের পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি খোঁজার স্থান। সে জন্যই মানসিকভাবে বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। হজ শয়তান ও অশুভ শক্তির প্রতি ঘৃণা প্রকাশ, পৌত্তলিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ তথা বারাআত ঘোষণা এবং খোদার সঙ্গে মিলনের স্থল। একই সঙ্গে তা পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা ‘শয়তানের ইবাদত করো না’– এ প্রতিজ্ঞারও নবায়নস্থল এবং ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) মুশরেকদের ওপর অসন্তুষ্ট’– এ বাণীর প্রতি সাড়া দেওয়ার স্থান। এ স্থান ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর ঔজ্জ্বল্য এবং তাঁদের আধ্যাত্মিক ও মানবিক সম্মান তুলে ধরার স্থান। হজ হলো জীবনের যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যহীনতা, ঠিক তার বিপরীত। শয়তানি শক্তি মানুষকে যে দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্যের দিকে পরিচালিত করে, হজ হলো তার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ। যে শয়তানি গোলক ধাঁধার আবর্তে মানুষ ঘুরপাক খাচ্ছে, এই হজ পালনের মাধ্যমে তা থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে পারবেন। হজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনার কাছে মুক্ত ও পরিষ্কাররূপে ফুটে উঠবে সেই পথ, যে পথের সাহায্যে আপনি চিরন্তন জগতে উত্তীর্ণ হয়ে মহান আল্লাহর সমীপে পৌঁছাতে পারবেন।
হজ সম্পর্কে একটি হাদিস প্রণিধানযোগ্য। হজরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশে হজ করল এবং অশালীন কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত রইল সে নবজাতক শিশু; যাকে তার মা এইমাত্র প্রসব করেছে; তার ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে। (বুখারি ১৪৩১)। হাজিরা এভাবে যাতে হজ করতে পারেন, সে জন্য আগেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। সবশেষে এটাও মনে রাখতে হবে, হজের সুযোগ সবার হয় না। আল্লাহ যাঁদের তাওফিক এবং হজ করার সৌভাগ্য দিয়েছেন, তাঁরা যেন সেভাবে এর মূল্যায়ন করেন।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন