আর সপ্তাহ দুয়েক পরেই উত্থাপিত হতে যাচ্ছে নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট। আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলন হিসাব নিয়ে উত্থাপিত বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে প্রায় পৌনে ৮ লাখ কোটি টাকা। নির্বাচন-পূর্ববর্তী বছরে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট উত্থাপিত হতে যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বেহাল দশা আর বিশ্ব অর্থনীতির টানাপোড়েনে আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বেশ আগ্রহী।

করোনা মহামারি দ্বারা সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা-পরবর্তী সময়ে জাতীয় বাজেট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেবে বলে আমরা আশাবাদী। পাশাপাশি সব সুবিধা সমভাবে সব নাগরিকের মধ্যে সুষমভাবে বিতরণ করা হয়েছে, তা নিশ্চিত করবে। ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোগ (এসএমই), কৃষি ও অনানুষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে; যা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি তৈরি করতে পারে। চাকরি সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের জন্যও তা গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের দ্রুত বিকাশমান ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপে দেশের ডিজিটাল রূপান্তর এবং ই-গভর্ন্যান্স সার্ভিসগুলোকে সাপোর্ট করা পরবর্তী জাতীয় বাজেটের জন্য অপরিহার্য, যা পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি উন্নত এবং নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, ডিজিটাল সাক্ষরতার প্রচার এবং দেশীয় আইসিটি সেক্টরের উন্নয়নে সহায়তা করা। জাতীয় বাজেটে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এটি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদার জন্য কর্মীবাহিনী প্রস্তুত করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব প্রশমিত এবং জলবায়ু সহনশীলতা ও পরিবেশগত স্থায়িত্ব উন্নয়নের জন্য আরও বরাদ্দ দেওয়া উচিত। এ লক্ষ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং অরক্ষিত সম্প্রদায় ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

শিল্প পরিচালনার ব্যয় কমানোর জন্য এ খাতসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়করের (এআইটি) হার কমিয়ে ৩ শতাংশ করা উচিত। বর্তমানে অগ্রিম আয়করের হার ৫ শতাংশ–যা ৩০ জুন ২০১০ পর্যন্ত ৩ শতাংশ ছিল। জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা এবং নারী ও সিনিয়র নাগরিকদের জন্য ৩ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা প্রয়োজন। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য সব উপজেলা পর্যায়ে আয়কর দপ্তর স্থাপন করা প্রয়োজন। বর্তমানে শুধু ভ্যাট নিবন্ধন ও ভ্যাট রিটার্নের ক্ষেত্রে অনলাইনে দাখিল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নোটিশ প্রদান, অনলাইনে ডকুমেন্টেশন আদান-প্রদান, অডিট, রিফান্ডসহ সব কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক হওয়ার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া ভ্যাট নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল, রিফান্ড, অডিটসহ সব কার্যক্রম করার ক্ষেত্রে অটোমেশন প্রয়োজন। এ পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে করদাতাদের ব্যবসা পরিচালনা করা অনেক সহজ হবে। তার সঙ্গে সঙ্গে মূসক কর্তৃপক্ষেরও করদাতাদের তদারক করা অনেক সহজ হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশনভিত্তিক উৎসে করের কার্যক্রম, আয়কর রিটার্ন দাখিল, অডিট নির্বাচন, কর নির্ধারণ, আপিল ও রিফান্ড প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা দরকার। নিম্ন আয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য পণ্য, সাধারণ পণ্য পরিবহন, নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিল্পের কাঁচামাল/উপকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রি-সাইক্লিং, টেন্ডারবহির্ভূত সরাসরি পণ্য মেরামত বা সার্ভিসিং খাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যে আমদানি সীমাবদ্ধ করার জন্য তালিকাভুক্ত পণ্য বা সেবার ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা উচিত।

গত ২৬ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে জাপান সফর করি। সেখানে বাংলাদেশ ও জাপানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে অনেক সিদ্ধান্ত হওয়ার পাশাপাশি জাপান বাজেট সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশকে ৩০ বিলিয়ন ইয়েন উন্নয়ন সহায়তা দেবে জাপান। আমাদের দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের প্রসারে যা একটি দৃষ্টান্ত।

সুদের টাকা পরিশোধ, জনকল্যাণে বড় আকারের ভর্তুকি দেওয়া, মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি– পরবর্তী বাজেটের জন্য চারটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া প্রতি বছর রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এতে বছর শেষে ঘাটতি দেখা যায়। অথচ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও আদায়ের মাধ্যমে অনেকখানি ঘাটতি সামাল দেওয়া সক্ষম। তবে জিডিপির ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে এটি মেজর কোনো সমস্যা বলে প্রতীয়মান হয় না।

বাংলাদেশে ব্যবসা সহজীকরণে সরকারকে আরও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি হ্রাস করা, নীতিমালাকে ব্যবসাবান্ধব করা এবং ব্যবসার নিবন্ধন ও লাইসেন্সের জন্য একটি স্বচ্ছ ও দক্ষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একটি অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে এবং স্থানীয় ব্যবসার প্রবৃদ্ধিকেও উৎসাহিত করে। এ ছাড়া ব্যবসায়িক নিবন্ধন ও লাইসেন্সের জন্য সুবিন্যস্ত পদ্ধতি এবং অর্থায়ন ও ঋণের অ্যাকসেস বাড়ানো উচিত। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য বাজেট যে ব্যাপক এবং কার্যকর, তা নিশ্চিত করতে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসতে হবে।

সৈয়দ আলমাস কবীর: সভাপতি, বাংলাদেশ–মালয়েশিয়া চেম্বার (বিএমসিসিআই); সিইও, মেট্রোনেট বাংলাদেশ লিমিটেড