- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- নারী পাচার: ফিরে আসার গল্প
নারী পাচার: ফিরে আসার গল্প

নারী পাচার রোধে বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে কিছুটা প্রশংসা পেলেও পাচারের নিত্যনতুন কৌশল উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বিয়ে, মডেলিং, বিদেশে চাকরির প্রলোভনসহ নানা ধরনের ফাঁদ। পাচার হওয়া নারী ফিরে এলেও তাঁকে সমাজ গ্রহণ করতে চায় না সহজে। তবে প্রতিকূলতার মধ্যেও অনেকেই ফিরে এসে নতুন করে শুরু করেছেন জীবন। তাঁদের সেই গল্প শুনে লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত।
মিনা খাতুনের (ছদ্মনাম) দাদাবাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। তবে বিয়ের পর বাবা কুমিল্লায় শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন। সেখানেই তাঁর বাবা চাকরি করতেন। এক ভাই চার বোনের মধ্যে মিনা সবার বড়। রাজবাড়ীতে দুরন্ত স্বভাবের মিনার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক লোকের সঙ্গে। হাজারো স্বপ্ন নিয়ে ওই লোকের হাত ধরে মিনা ভারতে যান। এটি প্রায় এক যুগ আগের কথা। তাঁকে অবৈধভাবে ভারতে পাচার করা হয়। এরপর মোটরসাইকেলে করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ঘোরার কথা বলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ায়। মূলত তাঁকে দিয়ে দেহব্যবসা করানো হয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় তাঁকে একটি এনজিও সংস্থা উদ্ধার করে। বিএনডব্লিউএলএ মিনার খোঁজ পায় দিল্লির একটি পার্টনার এনজিওর মাধ্যমে। ওই এনজিওর সহযোগিতায় কয়েক মাসের মধ্যে মিনাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ট্রমায় আক্রান্ত মিনা অত্যন্ত উদ্ধত হয়ে পড়েন। পরিবার ও সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসেন মিনা। এ সময় মামলার জন্য আবার গোয়ায় যেতে হয় মিনাকে। তাঁকে প্রায় দুই বছর সেখানে থাকতে হয়। এ সময় যে হোমে মিনা ছিলেন, সেখানে ইংরেজি ভাষা, কম্পিউটার ব্রাউজিংয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। দেশে ফিরে একটি পাঁচতারকা হোটেলের রিসিপশনে কাজ নেন তিনি। এর মধ্যে গাড়ি চালানোও শিখেছেন। কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন। ফিরে এসে বাড়িতে তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। বছর তিনেক আগে বিয়ে করেছেন।
কবিতা আক্তার মিতুর (ছদ্মনাম) বাড়ি নরসিংদী জেলায়। তাঁর পড়াশোনা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবা দিনমজুর। বয়স যখন ১৮ তখন তিনি গাজীপুরে একটি গার্মেন্টে কাজ শুরু করেন। সেখানে এক যুবককে বিয়ে করে ফেলেন। তিনি পেশায় গাড়িচালক। করোনার প্রথম ধাক্কায় কবিতার চাকরি চলে যায়। এক পর্যায়ে কবিতা বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁর স্বামী মাঝেমধ্যে কিছু টাকা পাঠাতেন। পরে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। স্বামীর দেখা নেই। কাজ নেই। সব মিলিয়ে ওই সময় কবিতা মানসিকভাবে খুবই দুর্বল ছিলেন। তখন বাড়ির পাশের এক নারী তাঁকে ভারতের পার্লারে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখান। অভাবের সংসারে যেখানে দু’মুঠো ভাত জোটে না, সেখানে সচ্ছলতার হাতছানিতে কাউকে কিছু না বলে তিনি ওই নারীর সঙ্গে চলে যান। কবিতাকে সাতক্ষীরায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে তাঁকে সীমান্ত পার করানো হয়। কলকাতায় গিয়ে সাত দিন রেখে তাঁর নকল কাগজপত্র তৈরি করা হয়। তখন ওই নারী তাঁকে অন্যদের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর সেখান থেকে তাঁকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় হায়দরাবাদে। সেখানে হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাঁকে যৌনকর্মে যুক্ত হতে বাধ্য করা হয়। কবিতা অপরাধীদের যে আস্তানায় ছিলেন, সেখানে পুলিশ অভিযান চালায়। সেখান থেকে কবিতাকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি শেল্টার হোমে রাখা হয়। প্রায় ১১ মাস কবিতা ওই হোমে ছিলেন। এরপর বিএনডব্লিউএলএর সহযোগিতায় ২০২১ সালের মাঝামাঝি কবিতা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কবিতা সেলাই মেশিনে ঘরে বসেই উপার্জনের পথ খুঁজে পান। গত বছর এলাকার এক ছেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
যাঁরা পাচারের শিকার হয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আটকা পড়েন, তাঁদের উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, দেশি-বিদেশি এনজিও এবং মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে বরাবরই কাজ করে যাচ্ছে বিএনডব্লিউএলএ। সংগঠনটির সারভাইভার সাপোর্ট কো-অর্ডিনেটর দীপ্তি বল বলেন, আট মাসের মাথায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) হালিমাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। মামলার প্রাথমিক কাজ শেষ করে তিনি বাবার সঙ্গে ঢাকায় মহিলা আইনজীবী সমিতির শেল্টার হোমে আসেন। সেখানে বসেই তিনি পড়াশোনা করেন। পরে বাড়িতে গিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। তাঁর পুলিশে কাজ করার খুব ইচ্ছা। তিনি সম্প্রতি সেই লক্ষ্যে পৌঁছেছেন।
হালিমা বেগমের (ছদ্মনাম) বাবা একজন দিনমজুর। তাঁরা দুই বোন। বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। সেখানেই করিমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তখন হালিমার বয়স ১৮। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে মারধর ও নির্যাতনের শিকার হন হালিমা। এক পর্যায়ে তাঁর বাবা পুলিশ নিয়ে গিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তখন হালিমা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাবার বাড়িতে চলে আসার কিছুদিন পর হালিমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন করিম। প্রায় রাতেই নিজের ভুল সম্পর্কে অনুতাপ জানাতে থাকেন। একদিন মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার কথা বলে হালিমাকে সাতক্ষীরা শহরে আসতে বলেন করিম। বাবাকে না জানিয়েই তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে পৌঁছালে তাঁকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয় অপরাধী চক্র। তাঁকে অচেতন করে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়।
জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটি রুমে আবিষ্কার করেন হালিমা। রুমের বাইরে তিন-চারজন পুরুষ পাহারায় ছিল। হালিমা তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কারা, এটা কোন জায়গা, আমার স্বামী কোথায়? তখন জানানো হয়, স্বামী তাঁকে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি কলকাতায় আছেন। হালিমা পাঁচ-ছয় দিন ওই ঘরে ছিলেন। এ সময়ে তাঁকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। অস্ত্রের মুখে হালিমা একদম চুপসে যান। এ সময় তাঁকে আরেক গ্রুপের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দু’জন লোক তাঁকে ট্রেনে উঠিয়ে দুই পাশে বসে। তাঁদের গন্তব্য ছিল মুম্বাই। হালিমার ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারা এবং চোখে পানি দেখে ট্রেনের টিকিট চেকারের সন্দেহ হয়। টিটিই এবং পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দুই অপরাধী পালিয়ে যায়। হালিমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। আদালতের মাধ্যমে হালিমাকে একটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) হালিমার কথা জানতে পারে। ফোনে কথা হলে হালিমা তাঁর ঠিকানা জানান। পুরো ঘটনা সম্পর্কে বলেন।
মন্তব্য করুন