- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- এরদোয়ান, ইমরান ও পিথা: উঠতি মধ্যবিত্তের নতুন দুনিয়া
সমকালীন প্রসঙ্গ
এরদোয়ান, ইমরান ও পিথা: উঠতি মধ্যবিত্তের নতুন দুনিয়া

তুরস্কের এরদোয়ান, পাকিস্তানের ইমরান খান আর থাইল্যান্ডের পিথা লিমজারোয়েনরাতের মধ্যে হাজারো অমিল দেখানো যাবে। মিলের দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাঁরা বিস্ময়ের বরপুত্র। রাজনীতিতে তাঁদের আবির্ভাব ও সাফল্যের মধ্যে চমক ছিল। তাঁদের রাজনীতি আলাদা, ব্যক্তিত্ব আলাদা; এমনকি ইতিহাসও আলাদা। কিন্তু কাছে বা দূর, যেদিক থেকেই দেখি না কেন, তাঁদের উত্থানের ব্যাকরণ অনেকটাই এক। পুরোনো রাজনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে তিনজনেরই শত্রুতা। পুরোনো মধ্যবিত্তরা তাঁদের চান না। তাতে কী, তাঁরা উঠতি মধ্যবিত্তের নায়ক। এই তিনজনের রাজনীতির বনিয়াদ ও কৌশলের গোড়ায় পাওয়া যাবে এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। কেউ কেউ যতই ‘খেলা হবে’, ‘খেলা হবে’ করুন; এই নতুন সামাজিক শক্তিকে হিসাবে না নিয়ে নতুন জমানার ভোটের রাজনীতিতে সাবেকি খেলোয়াড়দের পক্ষে সুবিধা করা কঠিন।
ইমরান খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেসামরিক প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল কৌশল। গোড়া থেকেই তিনি উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে টার্গেট করেছিলেন। এদের বড় অংশই তরুণ। এদের এবং যারা পুরোনো নেতাদের ধোঁকাবাজিতে অত্যন্ত ত্যক্তবিরক্ত। বর্তমান নিয়ে তারা হতাশ। অতীত নিয়ে গর্বে মেতে তাদের লাভ নেই। কারণ চাকরির সুযোগ ও বাজার বেজায় কঠিন। ইমরান খান এদের জাগালেন, এক করলেন। ব্যবহার করলেন সোশ্যাল মিডিয়া এবং বাজিমাত করে হয়ে গেলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি কাদের হারালেন? হারালেন পাকিস্তানের অভিজাত-জমিদার শ্রেণির জারদারি-ভুট্টো ও শরিফ পরিবারকে। সেনাবাহিনী তখনও বোঝেনি– তাদের পোস্টারবয় ইমরানই হয়ে উঠবেন সামরিক-অভিজাততন্ত্রের প্রধান শত্রু। এমনকি মার্কিনবিরোধী কথাবার্তা বলে, তাদের কূটচালে ক্ষমতা হারানোর পর তাঁর জনপ্রিয়তা আরও আকাশ ছুঁলো। কিছুদিন আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করার জবাবে পাকিস্তানে যে দাবানল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল, সেটা তাঁকে আবারও উঠিয়ে নিল নতুন ওই উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির গণজোয়ারের শীর্ষে। পাকিস্তানের ক্ষমতার দুই মূল খুঁটি সেনাতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র দ্রুতই গণবিক্ষোভের পাথুরে জমিতে হোঁচট খেল।
থাইল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে দেখুন। মাত্র ৪১ বছরের তরুণ পিথা লিমজারোয়েনরাতকে তাঁর দেশের বাইরে কে চিনত? তাঁর দল মুভ ফরোয়ার্ড বা এগিয়ে চলো পার্টির তরুণ নেতারা ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রথম মুখ দেখায়। যদিও তখন দলের নাম ছিল অন্য। ২০২৩ সালে এপ্রিলের জাতীয় নির্বাচনে পিথার দল পায় ৩৬ দশমিক ২৩ শতাংশ ভোট এবং ৫০০ আসনের মধ্যে ১৫২টি নিয়ে তারাই এগিয়ে। যদিও সরকার গঠনের জন্য মিত্রদের ১০০ আসনের সমর্থন লাগবে; তারপরও বলা যায়, তারাই জয়ী এবং সরকার গঠনের জন্য সবচেয়ে এগিয়ে এই তরুণ নেতা।
পিথা লিমজারোয়েনরাত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। প্রযুক্তি কোম্পানিতে চাকরি নেন। নিজে উচ্চ-মধ্যবিত্ত হলেও তাঁর সমর্থক বেশিরভাগই থাইল্যান্ডের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক এবং বেশিরভাগই তরুণ। নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের বেলাতেও অন্যদের থেকে তাঁদের আলাদা করে চোখে পড়ে। কারণ তাঁরা প্রচলিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লোক নন। রাজনৈতিক এলিটদের বাইরে থেকে এসেছেন। তাঁরা মানুষের দরজায় দরজায় গিয়ে দলের নীতি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁরা যেসব পরিবারের মন জয় করতে গেছেন, তারাও তাঁদের মতো উঠতি বা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁরা আধুনিক, উদার এবং প্রগতিশীল।
পাকিস্তানে ইমরান যাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, পিথার লড়াই একই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। দুই দেশেই এক ধরনের সামরিক শাসন চলছিল। পাকিস্তানে সামন্ত অভিজাত জমিদার আর থাইল্যান্ডে সামরিক কিংবা রাজতান্ত্রিক অভিজাত শ্রেণিই ছিল ক্ষমতায়। তাদের বড় ভাগটা দিয়েই অন্যদের রাজনৈতিক হিস্যা বুঝে নিতে হতো। ইমরান খানের দাবি মোতাবেক যদি পাকিস্তানে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন হয় কিংবা পরের নির্বাচনে যদি তাঁকে প্রার্থী হতে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি পিথার চেয়েও বেশি ভোটে উঠে আসবেন। এই ভোটাররা কারা? তাঁরা গ্রাম ও শহরের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক। বনেদিদের শিকড় মরে যাচ্ছে, সমাজে দেখা যাচ্ছে নতুন আকাঙ্ক্ষা ও নতুন রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ। এই সমাবেশ পুরোনো শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে না। তাদের দুর্নীতিময় মুখ তারা আর দেখতে চায় না। বিশ্বকাপজয়ী দলের সাবেক অধিনায়ক ও অলরাউন্ডার ইমরান খানই তাদের কাছে নতুন পাকিস্তানের প্রতীক। মোহভঙ্গ হওয়া জনগোষ্ঠীর মতো বিপজ্জনক ও বিক্ষুব্ধ আর কে? সাম্প্রতিক সহিংস বিক্ষোভে তারা সেই স্বাক্ষর রেখেছে। এই ইমরান সেনাবাহিনীর হাতে গড় লোক নন। এই শহুরে তরুণরা বিশ্বায়িত পৃথিবী আর ভোগের বৈষম্য দেখে দেখে ঠেকে ঠেকে শেখা মানুষ। এরাই পাকিস্তানি জনগণের ৬৫ শতাংশ। এদের হাতে আছে মোবাইল ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া।
এবার নজর ঘুরাই তুরস্কের দিকে; নতুন নামে যাকে ডাকা হচ্ছে তুর্কিয়ে। দুই দফা সরকার পরিচালনায় থাকা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তৃতীয়বারে এসে সামান্য ঝাঁকুনি খেয়েছেন। শত্রু ও বন্ধুরা তাঁকে ‘সুলতান’ নামে ডেকে থাকে। তুর্কি সুলতান এবার নির্বাচনের প্রথম দফায় ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাননি বিধায় তাঁকে আরেক দফা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। পরপর দুই দফা নির্বাচিত হওয়া যা তা কথা নয়। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক মন্দার মুখে দেশটির অনেক মানুষ ভালো নেই। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে সরাতে মরিয়া। তাদের সফ্ট পাওয়ার টুল তথা মিডিয়া-বুদ্ধিজীবী-থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং প্রচারণাযন্ত্র এরদোয়ানের ইমেজে আঁচড় কেটে চলেছে। কুর্দি ভোটারদের সমর্থন হারানোও তাঁর জন্য কৌশলগত ভুল ছিল। তারপরও অনেকে মনে করছেন, ২৮ মে’র দ্বিতীয় দফা ভোটে তিনি জয়ী হবেন।
আর্থিক জায়গায় পয়েন্ট কাটা পড়লেও এরদোয়ান মতাদর্শের অঙ্গীকার দিয়ে সফলভাবে তা ঢেকে রেখেছেন। অর্থনীতির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’ বা পরিচয়ের রাজনীতি। এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিচদারোগলু কামাল আতাতুর্কপন্থি ধ্রুপদি মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। পশ্চিমা আধুনিকতা, সেক্যুলারিজম এবং ইউরো মানসিকতা তাঁদের সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে স্পষ্ট করে। সেনাবাহিনী এমন ধারার দলকেই চায়। ওদিকে এরদোয়ান প্রতিনিধিত্ব করছেন গ্রাম ও শহরের উঠতি মধ্যবিত্তকে। এদের কাছে জাতীয় আত্মমর্যাদা, তুরস্কের খেলাফত আমলের সম্মান এবং সামাজিক সংহতি অনেক বড় বিষয়। এরদোয়ানের উত্থানের শুরুয়াৎ ছিল এই কম আধুনিক, বেশি জাতীয়তাবাদী উঠতি মধ্যবিত্তের কাঁধে সওয়ার হয়ে।
ইমরান খানের মধ্যপন্থি সমর্থক, পিথা লিমজারোয়েনরাতের প্রগতিশীল গোষ্ঠী, এরদোয়ানের মধ্যপন্থি অনুসারী– এই তিন গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক রাজনীতি একেবারে এক না হলেও আকাঙ্ক্ষায় তাঁরা গণতান্ত্রিক; অবস্থানে নতুন মধ্যবিত্ত।
খেয়াল করা দরকার, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল জমায়েতটি কিন্তু ছিল উঠতি মধ্যবিত্তরা। এই শ্রেণিটিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ-আমেরিকায় প্রধান জনগোষ্ঠী হিসেবে সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির খোলনলচে বদলে দিয়েছিল। আজকে এশিয়ায় এদের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। এরাই বৃহত্তম ভোক্তা বা কনজিউমার গোষ্ঠী। গত এক দশকে এদের আয় বাড়ছিল। কিন্তু এখন থমকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এদের অনেকেই নিজ নিজ দেশে অধিকার হারিয়ে ক্ষেপে আছে বা বাধ্য হয়ে চেপে আছে। দমিত হয়ে আছে। উন্নয়নশীল দুনিয়ায় এদেরই বলা হয় জনগণ। এদের মতই জনমত বলে গণ্য হয়। এরা শুধু দেশে নয়, বৈশ্বিকভাবেও প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। এবং এরা বড় হচ্ছে ও বড় হতে চাইছে।বাড়তে গিয়ে দেখছে পুরোনো মধ্যবিত্তরা সব আসন সব সুযোগের ওপর শক্ত করে বসে আছে। স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি এদের পরিত্যাগ করেছে। এদের সামনে এগোনোর পথ, ছেলেপুলে নিয়ে ভদ্র জীবনযাপনের উপায় হঠাৎ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দুর্যোগে বুজে আসছে, সংকুচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে সড়ক আন্দোলন, নো ভ্যাট আন্দোলনসহ যাবতীয় সামাজিক আলোড়নে পুরোনা মধ্যবিত্ত ও বনেদি অভিজাতরা ততটা ছিল না; গণতন্ত্রের দাবিতে জমায়েতেও তারা নেই। আছে এই উঠতি মধ্যবিত্তরাই। মরছে তারাই, ভুগছেও তারাই। থাইল্যান্ডের বিজয় এদের জন্য নিশ্চয়ই প্রেরণা হয়ে আসবে।
ফারুক ওয়াসিফ: পরিকল্পনা সম্পাদক, সমকাল; লেখক
মন্তব্য করুন