- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- কানাগলিতে ঢুকে পথ খুঁজছে পাকিস্তান
প্রতিবেশী
কানাগলিতে ঢুকে পথ খুঁজছে পাকিস্তান

সব দিক থেকে পাকিস্তানের জন্য বিশ্বের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর যখন কারও কোনো বিকল্প পথ থাকে না, তখন সে একটি গর্তের গভীরতম গভীরে পতিত হয়, যেখান থেকে পালানোর কোনো উপায় থাকে না। তাই সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পাকিস্তানও এখন একই রকম অবস্থায়। বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা তাই অন্ধকারমুখী এবং আশাহীন মরিয়া। দেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভয়াবহ। সাধারণ মানুষ কোনো রকমে জীবনযাপন করছে। কখনও কখনও তাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫০ শতাংশ স্পর্শ করছে। বৃহত্তর পরিসরে, দেশটি ঋণখেলাপি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এবং এটি যখন ঘটবে তখন পাকিস্তানকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হবে। বর্তমানে এর সব সূচক শ্রীলঙ্কার চেয়ে খারাপ, যে দেশটি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছে এবং মাত্র কয়েক মাস আগে আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঘোষিত হয়েছে।
ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো এতে মোটেও উদ্বিগ্ন নয় বলে মনে হচ্ছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য, সময় পার হয়ে গেলেও নির্বাচন না করা; সাংবিধানিক মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও ক্ষমতায় টিকে থাকা; বিরোধী দলকে (পড়ুন ইমরান খান) ক্ষমতার বাইরে রাখা (তাঁর জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও যদি সম্ভব হয় চিরকালের জন্য); প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা খুঁজে বের করে সেগুলোকে বশ্যতা স্বীকারের পর্যায়ে নামিয়ে আনা; ক্ষমতার ভারসাম্যকে তছনছ করে তাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা খর্ব করা; এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এ বল্গাহীন নিয়ন্ত্রণকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থেকে নিজেদের মুক্ত করা। এক উদ্দেশ্যেই জাতীয় জবাবদিহি ব্যুরো (এনএবি) বিষয়ক আইনগুলোকে কোনো তর্ক-বিতর্ক ছাড়াই তড়িঘড়ি করে সংশোধনের পাশাপাশি তাদের ভূতাপেক্ষ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়। তদন্তাধীন দুর্নীতির বেশিরভাগ মামলা এরই মধ্যে বাতিল হয়ে গেছে।
তারা যখন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু এবং অবকাঠামো ধ্বংসের কারণ ঘটিয়ে পরস্পরকে নির্মূল করার জন্য রাস্তায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখনও তারা সরকার বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের ধ্বংসাত্মক বিশ্বাসবিরোধী চ্যালেঞ্জগুলোকে নাকচ করার জন্য রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রক্ষমতার স্তম্ভগুলোকে হেয় করতে দ্বিধা করে না। আর এই সম্পূর্ণ স্বার্থপর, গোষ্ঠীতান্ত্রিক সংঘর্ষে দেশ এবং জনগণ নিরীহ দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের কেউ গোনায় ধরে না; এমনকি নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সরকার বাছাই করার ক্ষমতাও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয়। একচেটিয়া আধিপত্যের জন্য যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার এই যুদ্ধে জনগণ কার্যকরভাবেই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে গণতন্ত্র তো বটেই; দেশেরও অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।
অতীতে যখনই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তখনই সামরিক-বিচারিক যৌথ প্রয়াসে তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ পাওয়া গেছে। গত শতকের ৯০-এর দশকে নওয়াজ শরিফ এবং বেনজির ভুট্টোর জন্য পরস্পরের গদি উল্টে দেওয়া প্রায় স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ওই এক দশকে দু’জনের মধ্যে চারবার ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। প্রতিবারই প্রেসিডেন্ট, প্রধান বিচারপতি ও সেনাপ্রধান– এই ত্রিশক্তির সমন্বয়ে বিষয়গুলো নিষ্পত্তির মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক পথে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। গণতন্ত্রের একটি সনদ উভয়ের মধ্যে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘটিয়ে তখন জাতিকে সংসদের দুটি নিরবচ্ছিন্ন মেয়াদ উপহার দেয়। ইমরান খান সেই স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে এখন উভয়েরই অভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তিনি বহিরাগতের মতো দুয়ার ভেঙে ঘরে ঢুকে তাদের পার্টিকে তছনছ করে দিয়েছেন। এটাই বর্তমান অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার ভিত্তি।
এখন এমন এক সময় যখন বাহ্যিক ফ্যাক্টরের কারণে দ্বিধাবিভক্ত আদালতের একটা পক্ষ স্পষ্টত অসন্তোষের ক্ষোভে ফুটছে, এবং এতে আদালতের সালিশ করার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে; একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী তার নিজস্ব উপায়ে সমস্যার সমাধান চাচ্ছে। আর এ অবস্থায় সদ্যোজাত গণতান্ত্রিক ‘সিস্টেম’টি রয়ে গেছে তাদের হাতে, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংবিধান ও গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করতেও দ্বিধা করে না।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন এবং জাতি-রাষ্ট্রের ভেঙে পড়ার ভয় যখন এতটা বাস্তব, তখন কেয়ামত আমাদের খুব নিকটে– বললে ভুল হবে না। বিপর্যয় থেকে কেউ বাঁচবে না। রাজনীতিবিদরা তাঁদের দ্বন্দ্ব নিরসন করবেন– এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; তাঁরা বরং তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এ রক্তারক্তি খেলাকে শেষ পর্যন্ত নিতে ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। একটি পিটিশন শোনার সময় প্রধান বিচারপতি বারবার বাদী-বিবাদীকে রাজনৈতিকভাবে তথা নির্বাচনের মাধ্যমে সমস্যাটা সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে, পিডিএম তথা সরকার বরং আরও রক্তের জন্য হুংকার ছাড়ছে। মনে হচ্ছে, এবার তারা খোদ প্রধান বিচারপতির রক্ত চায়।
বিক্ষুব্ধ এবং বিচ্ছিন্ন ইমরান খানও তাঁর কৌশলে বিচক্ষণতা দেখাননি। বরং মনে হচ্ছে, তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটছেন এবং এভাবে একটি ভালো রাজনৈতিক দলকে জঙ্গি সংগঠনে পরিণত করার দিকে এগোচ্ছেন। এটি তাঁর এবং তাঁর দলের রাজনৈতিক পরিচয় ও ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। যারা তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, মনে হচ্ছে তারা তাদের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেছে। একটি অসাধু চক্র তাঁর দল পিটিআইকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে দিয়ে একটি সহিংস গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ভুল, বিপথগামী এবং কল্পিত ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে সামরিক স্থাপনা ভাঙচুর করতে লেগে যায়। একটি রাজনৈতিক দলের দ্বারা এর চেয়ে গুরুতর ভুল সংঘটিত হতে পারে না।
৯ মে যা ঘটানো হয়েছে তা শুধু অন্ধকার জগতেই সম্ভব। যারা হতাশার সময়েও আশায় বুক বেঁধে ছিল, তাদের বিরুদ্ধে এগুলো একটি প্রতারণা। এতে সেনাবাহিনীর সেন্টিমেন্টে আঘাত পাওয়া স্বাভাবিক। তবে পিটিআইর রাজনৈতিক বিরোধীরা যেভাবে নির্লজ্জের মতো ৯ মের ঘটনাবলিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, তা জঘন্য। এগুলো হলো এক ধরনের মাইন্ড গেম, যার উদ্দেশ্য সামরিক বাহিনী এবং পিটিআইর মধ্যে এরই মধ্যে সৃষ্ট ফাটলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া।
যে কোনো সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ছলচাতুরী এবং দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থাকবে এবং বিভাজনমূলক সামাজিক পটভূমির ফাঁদে পা দেবে না– এটাই প্রত্যাশিত। সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই একটি ঐক্যবদ্ধতার প্রভাবক শক্তি হিসেবে দেখা উচিত, যা এখনও জাতিকে শক্তিশালী করতে সক্ষম। যারা সহিংসতা করেছে এবং সামরিক বাহিনীকে অবজ্ঞা করেছে তাদের অবশ্যই বিচার হতে হবে; আর তা হতে হবে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এবং দোষীদের অপরাধের গভীরতা অনুপাতে শাস্তি দেওয়াই কাম্য। এর উদ্দেশ্য হলো বিভেদকে প্রশস্ত করার জন্য ছদ্মবেশী উপাদানগুলোকে পরিস্থিতি থেকে ফায়দা লুটতে না দেওয়া। সব রাগ-বিরাগ বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে যে, রাজনৈতিক অংশীজনের কাছ থেকে কোনো সমাধান না আসায়, ভঙ্গুর সিস্টেমটি মেরামতে তারা এখনও সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন
করতে পারে।
শাহজাদ চৌধুরী: রাজনৈতিক-সামরিক বিশ্লেষক; দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন
মন্তব্য করুন