আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এখনই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। বিশেষ করে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন অনেকে। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচনকালীন সরকার, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সমকাল কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার দুটি নিয়েছেন সমকালের সহ-সম্পাদক এহ্‌সান মাহমুদ।

সমকাল: গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এবারের ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রশ্নে আগেভাগে নিশ্চয়তা চাইছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনকালীন সরকার কেন অপরিহার্য মনে করেন?

দিলারা চৌধুরী: ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেশের মানুষ তেমন ভোট দিতে পারেনি। সেবার ক্ষমতাসীনরা এমন কৌশল করেছিল, যাতে ১৫৩টি আসনে ভোট দেওয়ার দরকার হয়নি। তাস খেলার মতো একটি খেলার ফলে মানুষ আর ভোট দিতে পারেনি। আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিলেও সেই নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকে। সেটি গত দুটি নির্বাচনে এসে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন ছাড়া এ দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। তাই এমন একটি কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার অপরিহার্য হয়ে পড়ছে।

সমকাল: নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ কেমন দেখছেন?

দিলারা চৌধুরী: আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে জঙ্গিবাদ দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আমরা দেখতে পেয়েছি, জঙ্গি ধরার নামে এখানে একটি ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে সমাজে কেউ প্রকাশ্যে কোনো আলাপ-আলোচনার সাহস দেখায় না। কোনো সমাজে যদি প্রকাশ্যে পক্ষে-বিপক্ষে আলাপ-আলোচনার সুযোগ না থাকে, তবে তো সেটি মৃত সমাজে পরিণত হয়। সেই হতাশাজনক ঘটনাই এখানে ঘটেছে। সিভিল সোসাইটিও বিভক্ত। ক্ষুদ্র স্বার্থে সিভিল সোসাইটি ব্যবহৃত হতে থাকলে সেই দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ তৈরি হয়।

সমকাল: অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

দিলারা চৌধুরী: এখন বর্তমান সরকার যেভাবে বলছে– তারা সংবিধানের বাইরে যেতে পারবে না; কিন্তু এই সংবিধান তো তারাই পরিবর্তন করেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী রেখে তো সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগ সরকারই আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনেছিল। এখন তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। সেই তিনটি নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়েছিল। এখন সরকার বলছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে, তাঁকে প্রধান করেই নির্বাচনকালীন সরকার করা হবে। এভাবে তো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যাবে না। কোনো দেশে পার্লামেন্ট রেখে নির্বাচন হয় না।

সমকাল: অনেক দেশেই তো সরকার বহাল রেখে নির্বাচন হয়।

দিলারা চৌধুরী: যেসব দেশে পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, সেখানে হাউস ডিজল্ভ করার পরে সবাই অনির্বাচিত হয়ে যায়। সেই সময়ে যে সরকারপ্রধান কিংবা মন্ত্রী থাকেন, কেউ কোনো সুবিধা পান না। সরকারি বাড়ি, সরকারি প্রটোকল বা নিরাপত্তা কিছু ভোগ করেন না। অন্য সব প্রার্থীর মতো তাঁরাও সাধারণভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় যান। তাঁরা নির্বাচনী প্রচারণার সময় কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন না। আপনি দেখেন, প্রতিবেশী ভারতে কীভাবে নির্বাচন হয়? একটি পার্লামেন্ট রেখে আরেকটি পার্লামেন্ট নির্বাচন বিশ্বের আর কোনো দেশে হয়– এ কথা আমার জানা নেই। একজন সিটিং এমপির বিরুদ্ধে একজন সাধারণ প্রার্থী কীভাবে নির্বাচন করবেন? পুলিশ ভাববে, এমপি সাহেব তো আবারও জয়ী হয়ে আসবেন! এমন পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয় কী করে?

সমকাল: তাহলে আমরা একটি ভালো নির্বাচন কীভাবে পেতে পারি?

দিলারা চৌধুরী: প্রথম কথা হচ্ছে, বর্তমান সংসদ তো প্রধানমন্ত্রীর হাতেই আছে। আইনত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তিনি তা পারবেন। পঞ্চদশ সংশোধনী ফিরিয়ে দিতে হবে। ১৯৯৬ সালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, সেটিও ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ তৈরি হবে।

সমকাল: তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানে রাজনীতিটা রাজনীতিকদের হাত থেকে চলে যাওয়া নয়?

দিলারা চৌধুরী: দেখুন, এখন রাজনীতিটা চলে গেছে দুর্নীতিবাজদের দখলে। অর্থ পাচার ও লুটপাটের রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে এই সরকারের আমলে। রাজনীতি সংশোধনের মাধ্যমেই এটাকে সংশোধন করতে হবে। যে সরকার জনসাধারণকে তোয়াক্কা করে না, সেই সরকার তো জনসাধারণের সরকার থাকে না। কখন একটি সরকার জনসাধারণকে তোয়াক্কা করে? যখন সে দেখে, তাকে নির্বাচিত হওয়ার জন্য পাঁচ বছর পরে হলেও জনসাধারণের সামনে দাঁড়াতে হবে; তখন সে মনে করে– আমাকে তো ভোট চাইতে দাঁড়াতে হবে। তার বদলে সে যদি দেখে জনগণের ভোটের কোনো দরকার নেই, তাহলে সরকার আর জনসাধারণকে তোয়াক্কা করতে চায় না। বর্তমান সরকার দেখছে, গত দুটি নির্বাচন তারা এভাবে করে এসেছে। এখন সামনের নির্বাচনও এভাবে করতে চায়। আবার এখন শোনা যায়, কেউ কেউ জাতীয় সরকার নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

সমকাল: জাতীয় সরকার ধারণা নিয়ে আপনার মতামত কী?

দিলারা চৌধুরী: আমি একটি কথা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক বিষয়াদি রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। জাতীয় সরকারের নামে কয়েকজন অরাজনৈতিক লোক এসে এখানকার রাজনীতি ঠিক করে দিয়ে যাবেন– এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমরা এর আগে ওয়ান-ইলেভেন সরকার দেখেছি। সেই সময়ের সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাতে লাভ হয়েছে কি? এর পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। তারা এসে তো সব বাতিল করে দিয়েছে। তাই রাজনৈতিক প্রশ্ন রাজনৈতিকভাবেই মীমাংসা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো বসেই তা করেছিল।

সমকাল: এখন কি দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বসে বিষয়টি ঠিক করতে পারে?

দিলারা চৌধুরী: দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আগের সে বিশ্বাস আর নেই। এখন দুটি দলের মধ্যে সীমাহীন অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। দুটি দলের একজন অন্যজনকে ঘৃণা করে। রাজনীতিতে থাকা দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল যদি আলাপের জন্য এক জায়গায় বসতে না পারে, তাহলে কীভাবে হবে! এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় আমরা দেখেছিলাম সরকার বলেছিল, এটা একটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। পরে আবার নির্বাচন দেওয়া হবে। সে কথা বিদেশিদের কাছে সরকার বলেছিল। তারা আবার বিএনপিপ্রধানকে বুঝিয়ে সম্মতও করিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনটি করার পরেই সরকার তার আসল চেহারা দেখাল। এতে কোনো প্রকার আস্থার সুযোগ আর রইল না। তখন দেশে যদি শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি থাকত, তাহলে তারা সরকারকে বলতে পারত– আপনারা এখন কথা রাখছেন না কেন? কিন্তু সেটা তো আমাদের এখানে হলো না।

সমকাল: শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি কেন তৈরি হলো না বলে মনে করেন? 

দিলারা চৌধুরী: আমাদের দেশে বিসমিল্লায় গলদ ছিল। অর্থাৎ দেশটি শুরু থেকেই সরকারের হাতে অসীম ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিল। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। সিভিল সোসাইটির কাজ রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে কাজ করা। কিন্তু এখানে সেটি হয়নি। যখন কোনো সিভিল সোসাইটি নির্দিষ্ট পার্টির লেজুড়বৃত্তি শুরু করবে, তখন থেকেই তার শক্তি শেষ হয়ে যাবে। আমাদের এখানকার সিভিল সোসাইটির মাথায় দলীয় টিকি বাঁধা। টিকি বাঁধার ফলে তাদের দ্বারা স্বতন্ত্র কিছু বলা সম্ভব হয় না।

সমকাল: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে আপনার পরামর্শ কী?

দিলারা চৌধুরী: সরকারকে নিজের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতীয় সরকারের নামে পাঁচ বছরের একটি সরকার আসবে, তারা দেশ শাসন করবে– এটা আমি চাই না। আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কথার বাহাস হবে, ঝগড়াঝাঁটি হবে, মারামারি হবে– নিজেরাই আবার সব ঠিক করবে। রাজনৈতিক বিষয়গুলোর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই আসা উচিত।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

দিলারা চৌধুরী: সমকালকেও ধন্যবাদ।