- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- তরুণরা ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসী হচ্ছে কেন?
মানবসম্পদ
তরুণরা ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসী হচ্ছে কেন?

সৈয়দা রোজানা রশিদ তাঁর ‘আনসার্টেইন টুমরো: লাইভলিহুডস, ক্যাপিটাল অ্যান্ড রিস্কস ইন লেবার মাইগ্রেশান ফ্রম বাংলাদেশ’ (ইউপিএল, ফেব্রুয়ারি, ২০১৬) গ্রন্থে বাংলাদেশের মানুষদের অভিবাসী হওয়ার কার্যকারণ, তাদের জীবন-জীবিকার ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। ২০০৫-০৬ সালে পিএইচডি গবেষণার অংশ হিসেবে রোজানা রশিদ যখন কুমিল্লার দুটি গ্রামের মানুষদের অভিবাসনের কার্যকারণ বোঝাপড়ার কাজটি করছিলেন, তখনও বলা হতো– বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। কথিত এই জোয়ারের মধ্যেও কেন গ্রামবাংলার শ্রমজীবী মানুষ অভিবাসী হয়, তা উঠে এসেছে এ গবেষণায়।
দেখা গেছে, অভিবাসনে যে ঝুঁকি আছে, তা মানুষ ভালো করেই জানে। কিন্তু এর মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার সুযোগও তারা দেখতে পায়। আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার মাঝে এমন অনেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি আছে, যার ফলে অভিবাসনকে তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। রোজানা রশিদ সে সময় উপলব্ধি করেন, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে এমন কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, যেখানে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে।
সেই গবেষণার পর দেড় দশকেরও বেশি সময় পার হয়েছে। এই সময়টুকুতে টাকার অঙ্কে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কিন্তু এ দেশের শ্রমজীবী তরুণরা নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে, এ রকম কোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি গড়ে উঠেছে? ব্যয়বহুল অবকাঠামোকেন্দ্রিক উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যেও মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এমনকি নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের তরুণদের বিদেশ গমনের পরিসংখ্যান তো ভিন্ন কথা বলে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বরাতে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ পথে নৌকায় করে ইতালিগামী বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালে এই পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশির হার ছিল ৫ শতাংশ। ২০২১ সাল শেষে তা বেড়ে ১২ শতাংশ এবং ২০২২ সাল শেষে তা ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এসব অভিবাসনপ্রত্যাশী তুরস্ক, মিসর বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে প্রথমে আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত দেশ লিবিয়া যায়। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসগার হয়ে ইতালির পথে যাত্রা করে। আইওএমের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে এ পথ ধরে প্রবেশ করেছে ১৫ হাজার ২২৮ বাংলাদেশি। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৮৩৮। বর্তমানে ইতালিমুখী বোট পিপলের উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
ভূমধ্যসাগরীয় রুটের পর বাংলাদেশিরা বেশি ব্যবহার করে বলকান রুট। গত কয়েক বছরে এ রুট দিয়ে ছয় হাজারের বেশি বাংলাদেশি ইউরোপে গেছে। এভাবে ঢুকতে গিয়ে বসনিয়ার জঙ্গলে বাংলাদেশিদের আটকে থাকার ঘটনাও ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন– ভূমধ্যসাগর, জঙ্গল আর মরুভূমি পেরিয়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি তরুণ কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে অভিবাসী হতে চাচ্ছে। এই তরুণরা দেশের ভেতরে যদি ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ, সুন্দরভাবে বাঁচার মতো মজুরি পেত; যদি তাদের কর্মস্থল নিরাপদ হতো তাহলে তারা এ রকম মরিয়া হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিত? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসা কয়েকজন অভিবাসনপ্রত্যাশীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জেনে নেওয়া যেতে পারে।
যেমন শরীয়তপুরের জুমন আহমেদ প্রথমে আকাশপথে দুবাই হয়ে তুরস্ক যান; তারপর তুরস্ক থেকে লিবিয়া হয়ে বিপৎসংকুল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি। এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার আগে তিনি মিরপুরের একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন। প্রায় তিন বছরে সেখানে কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি তাঁকে। বেতনও পেতেন মালিকের ইচ্ছামতো। তিনি জানান, কেবল উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়ায় চাইলেও চাকরি পরিবর্তন করতে পারছিলেন না। সে কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেন।
সার্বিয়া হয়ে ইতালিগামী বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণ আরাফাত রহমান ইনফোমাইগ্র্যান্টস নামে অভিবাসনবিষয়ক একটি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে নিম্ন বেতনে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরির জন্য বিপুল পরিমাণ ঘুষ দেওয়ার বদলে সেই টাকা খরচ করে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
২০১৯ সালে নৌকায় করে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে মারা যাওয়া সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার তরুণ খোকন আহমেদ কেন এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন? সংবাদমাধ্যমের কাছে খোকনের ভাই লিটনের দেওয়া বক্তব্য থেকে জানা যায়, তাঁদের দোকানদার পিতা পাঁচ বেকার সন্তানের মধ্যে তুলনামূলক শিক্ষিত খোকনকে ভালো কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় দোকান বন্ধক রেখে টাকা ধার করে ইতালির পথে পাঠান।
এ রকম আরও দৃষ্টান্ত রয়েছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা থাকবেই। চিরকাল কেউ নিম্ন মজুরির কঠোর শ্রমের কাজে আটকে থাকতে চায় না। দেশের ভেতরে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজের সুযোগ না থাকলে, দেশের বাইরে গিয়ে হলেও সে তা অর্জন করতে চাইবে।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার ১১ হাজারেও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর ওপর জাতিসংঘের অভিবাসীবিষয়ক সংস্থা আইওএমের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশের বিদেশ যেতে চাওয়ার কারণ হলো ভালো কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবন-জীবিকার প্রত্যাশা। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ঋণগ্রস্ততা, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা, দেশে কোনো ভবিষ্যৎ না থাকা ইত্যাদি। শুধু তাই নয়; ৯১ শতাংশ অভিবাসনপ্রত্যাশীই জানিয়েছেন, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও মান বৃদ্ধি পেলে তাঁরা বিদেশ গমন করবেন না। অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে যাঁরা ইউরোপ-আমেরিকা যেতে চান, তাঁদের বেশিরভাগই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় বা তদূর্ধ্ব শিক্ষিত।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এ রকম বিভিন্ন অভিবাসনপ্রত্যাশীর অভিজ্ঞতা ও নানা জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনো মোটামুটি শিক্ষিত তরুণ অনেকেই দেশের ভেতর এমন কোনো কর্মসংস্থান পান না, যার মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করা যাবে। ফলে অনেক সময় ঝুঁকি জেনেও সাগর বা জঙ্গল পেরিয়ে ইউরোপের পথে যাত্রা করেন। আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়া শ্রমিকরাও অনেক সময় কঠোর পরিশ্রম করে প্রত্যাশা অনুযায়ী আয় করতে না পেরে আরেকটু ভালো আয়ের আশায় ইউরোপে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
বাংলাদেশের তরুণ শ্রমজীবীদের জন্য দেশের ভেতরে যতদিন পর্যন্ত মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান, ভালোভাবে বাঁচার মতো মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা না যাবে, ততদিন পর্যন্ত এই ভূমধ্যসাগরের পথে ঝুঁকিপূর্ণ ইউরোপযাত্রা বন্ধ হবে না।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী, উন্নয়ন, অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
মন্তব্য করুন