গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর এই সপ্তাহে চীনের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিনসহ সর্বোচ্চ পদমর্যাদার রাশিয়ান কর্তাব্যক্তিদের একটা দল বেইজিং ও সাংহাই সফর করেছে। তাঁরা এমন সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব চরমে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য গত বছর ১৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছার রেকর্ড করেছে। চলতি বছর এটি ছাড়িয়ে যাবে, রাশিয়ার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা যার অন্যতম কারণ। চীনে এই বছর রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বুধবার সফররত অবস্থায় চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংকে মিশুস্তিন বলেন, ‘রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক এখন এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় রয়েছে।’ তিনি ‘পশ্চিমাদের সম্মিলিত চাপ’ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থের বিষয় তুলে ধরেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আস্থাভাজন মিশুস্তিনের সঙ্গে বৈঠকে শি জিনপিং ভূ-রাজনৈতিক প্রকল্প গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁদের প্রতিবেশীদের নিয়ে ‘বৃহত্তর আঞ্চলিক বাজার’ তৈরির কথা বলেছেন। চীনের সিনহুয়া নিউজ সার্ভিসের খবর অনুসারে, মিশুস্তিন বলেছেন, তাঁর সরকার ‘বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থা উৎসাহিত করতে এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে চীনের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।’

ইউরেশিয়াবিষয়ক বেইজিংয়ের দূত লি হুইয়ের শুক্রবারের মস্কো সফরের আগে চীনে মিশুস্তিনের এই সফর অনুষ্ঠিত হয়। চীনের লি হুই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভসহ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। কূটনীতির এই সফরগুলো গত সপ্তাহে জাপানে জি৭-এর শীর্ষ সম্মেলনের পর দেখা যাচ্ছে, যে সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার কিছু ঘনিষ্ঠ মিত্র দীর্ঘ এক বিবৃতিতে চীনের ‘অর্থনৈতিক হুমকি’র রেকর্ডের কথা বলেছে। তারা জিনজিয়াং ও হংকংয়ে চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালিতে দেশটির আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের কথাও বলেছে।

জি৭ সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং সেখানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপস্থিতির অর্থ, তারা মস্কো এবং বেইজিং উভয়কেই শক্তভাবে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছে। ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা চ্যাথাম হাউসের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রোগ্রামের পরিচালক বেন ব্ল্যান্ড গার্ডিয়ানকে বলেছেন, শীর্ষ সম্মেলনের বিবৃতি ‘যেমন চীন ও রাশিয়ার মধ্যে গভীর ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনকে তুলে ধরছে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের মধ্যে গভীরতর ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনকেও গুরুত্ব দিচ্ছে।’ অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার আলেকজান্ডার কোরোলেভ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘জি৭ শীর্ষ সম্মেলনের পর রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক দ্বিগুণ করতে প্রস্তুত চীন। কারণ এই শীর্ষ সম্মেলনের মূল বিষয় কেবল ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নয় বরং চীনও ছিল, যেখানে তারা আলোচনা করে কীভাবে চীনকে পশ্চিমাদের মোকাবিলা করা উচিত।’

চীন বিশেষ করে জাপানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। আর জাপানই এবার জি৭ সম্মেলনের আয়োজক ছিল। চীনের হুমকি মাথায় নিয়ে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিবাদী সংবিধানকে পুনরায় চালু করতে কাজ করছে। রাশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করতে ন্যাটো জাপানে একটি দপ্তর খোলার পরিকল্পনা করছে– এমন খবর চীনের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনা কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকরা খোলাখুলিভাবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ‘ন্যাটো-করণ’-এর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। প্রতিরক্ষা অগ্রাধিকারবিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্কের চীন এবং রাশিয়া উভয় দেশ বিশেষজ্ঞ লাইল গোল্ডস্টেইন আমাকে বলেছিলেন, এশিয়ায় ন্যাটোর তৎপরতা ‘চীনকে যেমন অস্বস্তিতে ফেলছে, তেমনি (দুই দেশকে) কাছাকাছি আনার রাশিয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।’

তবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও চীন এবং রাশিয়া জোরালো মিত্র নয়। গোল্ডস্টেইন সম্প্রতি চীনে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তিনি একাধিক নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের চীনাবিষয়ক বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তারা স্বীকার করেছিল, ইউক্রেন আক্রমণ রাশিয়ার ব্যর্থতা হলেও পুতিনের পতনে চীনের স্বার্থ নাও থাকতে পারে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়া যখন বেইজিংয়ের সঙ্গে তার অনুমিত ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্ব ভালো করতে চায়, তখন চীনা কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকরা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে পূর্ণাঙ্গ জোট নয় বলে আখ্যায়িত করছেন।

গোল্ডস্টেইন বলেছিলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে, চীন সংযমের সঙ্গে কাজ করছে এবং আমি মনে করি না, এটি পশ্চিমে প্রশংসিত হয়েছে।’ পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংযম ম্লান হতে পারে। রাশিয়ার আগ্রাসনের পর মস্কোকে চীনের কাছে তার ‘জুনিয়র পার্টনার’-এর মর্যাদা পেতে হয়েছিল। কারণ রাশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য চীনা ক্রেতাদের ওপর এবং উন্নত প্রযুক্তিগত পণ্যের জন্য চীনা বাজারের ওপর নির্ভরশীল। এটি এমন এক ঐতিহাসিক অবস্থা, যা দীর্ঘ সময় ধরে নতুন অস্বস্তিকর গতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের পরিচালক আলেকজান্ডার গাবুয়েভ গত মাসে পররাষ্ট্রবিষয়ক এক সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘রাশিয়ার আকার এবং ক্ষমতা ক্রেমলিনকে নিরাপত্তার একটি মিথ্যা ধারণা দিতে পারে। কারণ এটি বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি অসম সম্পর্কের মধ্যে আটকে আছে।’ তিনি বলছেন, “কিন্তু এই সম্পর্কের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে দুর্বল রাশিয়াকে পরিচালনা করার মতো চীনের ক্ষমতার ওপর। আগামী বছরগুলোতে পুতিনের শাসনকে সেই দক্ষতা শিখতে হবে, যা বিশ্বজুড়ে ‘জুনিয়র পার্টনাররা’ বেঁচে থাকার জন্য শেখে: কীভাবে অবস্থা উন্নত করা যায়।”

ঈশান থারুর: ওয়াশিংটন পোস্টের বিদেশবিষয়ক কলাম লেখক; দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক