
আমার ৫০ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে দুঃখের সঙ্গে দেখেছি, এ দেশকে প্রথমে স্বল্পোন্নত, তারপর ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং এখন বিশ্বের চোখে অপমানিত রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অপমানের যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায় যখন আফগানিস্তানের সরকার পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং তার জনগণকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে নসিহত করে। দেশটির সরকার সম্প্রতি একটি অফিসিয়াল বিবৃতির মাধ্যমে কাজটি করেছে।
জাতীয় পুনরুজ্জীবনের পথ রচনায় মূল পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি হলো, পাকিস্তানের চলমান সংঘাতের স্বরূপ বোঝা। এটি রাজনীতিবিদের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে যুদ্ধ, সামরিক সংস্থার মাধ্যমে তলোয়ার/জবরদস্তি এবং বিচারকদের মাধ্যমে কলম/সাংবিধানিক ক্ষমতার লড়াই।
৯ মে’র ঘটনার মধ্যে জনতার যে রুদ্ররোষ দেখা গেল, তা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি এবং ইমরান খান এই গণঅভিব্যক্তির একটি বাহক মাত্র। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সাহসী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তা একটি সংকটময় মুহূর্তে পৌঁছেছে। এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও প্রকাশ তিনটি অগ্রগতিমূলক ঘটনায় দেখা যায়।
প্রথমত, জেনারেল আইয়ুব ও ইয়াহিয়া জনগণের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি বলে বিবেচিত সংবিধান বাতিল/রহিত করলেও, তাঁদের উত্তরসূরি জেনারেল জিয়া এবং মোশাররফ তা করার সাহস পাননি। তাঁরা শুধু সংবিধান স্থগিত করেছিলেন। আশ্চর্যজনক মনে হলেও এতে স্পষ্ট, এমনকি এস্টাবলিশমেন্ট তথা ক্ষমতার নেপথ্য ধারকরা এখন তাঁদের মতো করে হলেও সংবিধানের গুরুত্ব বোঝেন এবং সে কারণেই তা বাতিল করতে ভয় পান।
দ্বিতীয়ত, খুন, রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা, বিদেশে নির্বাসন, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন ইত্যাদির শিকার হওয়ার পরও রাজনৈতিক এলিট ও তাঁদের কর্মীরা কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকেন এবং সুযোগ পেলে এস্টাবলিশমেন্টকে লাথি মারেন; তার বিরুদ্ধে লড়াই করেন। আবার ভিন্ন পরিস্থিতিতে এস্টাবলিশমেন্টের দালালি করেন।
তৃতীয়ত, যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আসিম সাজ্জাদ তাঁর বই ‘দ্য স্ট্রাগল ফর হেজেমনি ইন পাকিস্তান’-এ সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করার মতোই বলেছেন: ‘উত্তর ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত অনেক ঘটনাই পাওয়া যাবে, যেগুলোর সঙ্গে পিটিআই তথা ইমরান খানের দলের উত্থানের অভিজ্ঞতাকে মেলানো যায়। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাঙ্ক্ষার ধারক একটি তরুণ এবং ডিজিটালভাবে সংযুক্ত জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে এমন এক কণ্ঠস্বর শোনা যায়, যা প্রতিক্রিয়াশীল এবং ‘আধিপত্যশীল অভিজাতদের’ একচেটিয়া ক্ষমতা ভাঙার দাবি জানায়।
পাকিস্তান বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্বারা সংঘটিত এমন দ্বিতীয় ঘটনার সম্মুখীন। এ ধরনের ঘটনা প্রথম দেখা গিয়েছিল ২০০৭ সালে, প্রবল আইনজীবী আন্দোলনের মধ্যে। আর এখন দেখা যাচ্ছে ইমরান খানের আন্দোলনে। ‘জনতা’রূপী এ ভূতকে সামরিক আদালতের ‘শাটআপ’ ধমক বা পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে এনে বোতলবন্দি বা চুপ করানো যাচ্ছে না।
লক্ষণীয়, একাধিকবার চেষ্টা করেও ১৬ বছর ধরে এ দেশে কোনো সরাসরি বা ছদ্মবেশী সামরিক শাসন ফিরিয়ে আনা যায়নি। এই ১৬ বছর আমাদের একটানা আনুষ্ঠানিক সাংবিধানিক শাসনের দীর্ঘতম কাল। প্রভাব না হলেও ক্ষমতার ওপর এস্টাবলিশমেন্ট প্রতিষ্ঠার একচেটিয়া আধিপত্যের দিন শেষ। সরাসরি সামরিক শাসন চাপানোর আবারও চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মতো এটি এস্টাবলিশমেন্টের আধিপত্যের অবসান ঘটাতে পারে।
এটা সত্য, বেসামরিক আধিপত্য ও গভীর সাংবিধানিক উদার গণতন্ত্রের স্বপ্ন পূরণের জন্য যে টেকসই গণসংহতি ও বিপ্লবী রাজনীতির প্রয়োজন ছিল, তা এ মুহূর্তে চোখে পড়ছে না। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ওপর আরও কিছু বছর একটি শক্তিশালী সামরিক ছাপ থাকতে পারে, কিন্তু এস্টাবলিশমেন্টের একচেটিয়া ভাব আর খাটবে না। অর্থাৎ বড়জোর এক ধরনের হাইব্রিড শাসন চলতে পারে।
এ কথাও মানতে হবে, সামরিক বাহিনী ও এর গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা তিনটি কারণে এ দেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সহিংস হয়ে ওঠার ওপর সামরিক বাহিনী ছাড়া কোনো শক্তিই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। দুর্বল সামরিক বাহিনী মানে গৃহযুদ্ধ এবং বিশৃঙ্খলার ছড়াছড়ি। দ্বিতীয়ত, এস্টাবলিশমেন্টের মদদ ছাড়া কোনো মৌলিক সংস্কার সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, শুধু একটি শক্তিশালী এবং পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীই সীমান্তে দুটি হুমকি থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে– আফগানিস্তান থেকে ইসলামী চরমপন্থার রপ্তানি এবং এ অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদী ভারতের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য। মোট কথা, আমাদের তরবারি দরকার, কিন্তু তা জনগণ বা সংবিধানকে বশীভূত করার জন্য নয়।
রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য বিচার বিভাগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ আদালতই পারেন জনশক্তি এবং তরবারির অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে। উচ্চ আদালত ইতোমধ্যে সংখ্যাগুরুবাদের আধিপত্য থেকে দুর্বল ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে রক্ষার্থে সাংবিধানিক গ্যারান্টার হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। এ ছাড়া এটি সাংবিধানিক গণতন্ত্রের সামরিকীকরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্রমাগত হুমকির বিরুদ্ধে একটি সাংবিধানিক প্রাচীর হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের ভূমিকা আরও অনেক মৌলিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ: জনগণের অধিকার সম্পর্কিত সংবিধানের মূল্যবোধকে রক্ষা করা, ছড়িয়ে দেওয়া এবং একটি আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল মূল্যবোধসমৃদ্ধ অত্যন্ত আধুনিক সংবিধান, যা আমাদের বর্তমান অবমাননা দূর করতে সাহায্য করবে। অতএব, আমাদের বিচার বিভাগের হাতে যে কলম আছে, তা দরকার। তবে তা যেন গণতন্ত্রকে বিচার বিভাগমুখী বা সামরিক বাহিনীর ‘অতি সাংবিধানিকীকরণ’-এর চেষ্টায় ব্যবহৃত না হয়।
এ জাতির ভাগ্য নিহিত মানুষ, তরবারি ও কলমের ভারসাম্যে। তবে এ ধরনের ভারসাম্যের প্রথম ধাপ হিসেবে তিনটি জিনিস প্রয়োজন: অবিলম্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে আত্মধ্বংসী অচলাবস্থার অবসান এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেবেন না– এ নিশ্চয়তা দেওয়া।
ফয়সাল সিদ্দিকী: পাকিস্তানি আইনজীবী; ডন ডটকম থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন
মন্তব্য করুন