- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- সকলই গরল ভেল!
সকলই গরল ভেল!
দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পট বা বিনোদন কেন্দ্রে বেড়াইতে গিয়া পর্যটকগণ নানাবিধ অপরাধের শিকার হইতেছেন বলিয়া শনিবার সমকালের প্রতিবেদনে যেই তথ্য দেওয়া হইয়াছে, উহা উদ্বেগজনক হইলেও বিস্ময়কর নহে। পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে বিভিন্নভাবে পর্যটক হেনস্তার খবর প্রায়শ সংবাদমাধ্যমের উপজীব্য হইয়া ওঠে। ভুক্তভোগীদের বরাতে আলোচ্য প্রতিবেদনেও বলা হইয়াছে, যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে প্রায় সকল পর্যটনকেন্দ্রে অপরাধীরা কীভাবে বেপরোয়া হইয়া উঠিয়াছে। হেনস্তা তো বটেই; ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, ছিনতাইয়ের মতন গুরুতর অপরাধজনক ঘটনাও ঘটিতেছে।
স্বীকার করিতে হইবে, বিলম্বে হইলেও পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানে দেশে পর্যটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। কিন্তু উক্ত সংস্থা প্রদত্ত তথ্যেই জানা যাইতেছে, দেশে দেড় সহস্রাধিক পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ১০৪টি কেন্দ্রে পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করিতেছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা। অর্থাৎ অধিকাংশ পর্যটনকেন্দ্র সম্পূর্ণ অরক্ষিত। শুধু উহাই নহে, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অংশের প্রশ্নবিদ্ধ দায়িত্বশীলতার কথাও স্মরণে রাখিতে হইবে। এমন খবর বিরল নহে, কক্সবাজার বা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের ন্যায় সুপরিচিত পর্যটনকেন্দ্রেও নারী পর্যটকগণ খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যদের হস্তে নিগৃহীত হইয়াছেন। ইহা স্পষ্ট, দেশে পর্যটনের সম্ভাবনা লইয়া যত, উহার নিরাপত্তা ব্যবস্থা লইয়া ততটা উদ্যোগ নাই।
বন, পাহাড়, নদী, সমুদ্র ও হাওর সমন্বয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রাকৃতিক উপাদান যে বাংলাদেশে বিদ্যমান, উহা সকলেই স্বীকার করেন। বিশেষত কর্মসংস্থান সৃষ্টির সক্ষমতা বিবেচনায় পর্যটন যে বর্তমানে বহু দেশের জন্য একক বৃহত্তম খাত, তাহাও সকলের জানা। বলা হইয়া থাকে, পর্যটনের কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত যেই উন্নয়ন সাধিত হয়, তাহার ফলস্বরূপ বর্তমানে পৃথিবীর চারটা কর্মসংস্থানের মধ্যে একটা কর্মসংস্থান তৈরি হয় এই খাতে। বৃহৎ এই চিত্র সম্মুখে রাখিয়া গত কয়েক বৎসরে পর্যটনকেন্দ্রসমূহের উন্নয়ন, এমনকি নূতন পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের জন্য বহু প্রকল্পও গ্রহণ করা হইয়াছে। কিন্তু সেই সকল পর্যটনক্ষেত্রে নিরাপত্তাই যদি না থাকে, তাহা হইলে তো সকলই গরল ভেল!
স্মরণে রাখিতে হইবে, নিরাপত্তার ন্যায় মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ না হইলে শুধু পর্যটনক্ষেত্র সম্প্রসারণে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ হইবে না। বস্তুত উহার লক্ষণও স্পষ্ট। বর্তমানে যথায় বাংলাদেশ পর্যটন খাত হইতে উপার্জন করে কমবেশি ৭৬ মিলিয়ন ডলার, তথায় প্রতিবেশী ভারত আয় করিতেছে প্রায় ১১ সহস্র মিলিয়ন ডলার। ভারত শুধু বৃহৎ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ বলিয়া নহে; আমরা দেখিতেছি- মালদ্বীপ ৮০২ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কা ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার এবং নেপাল ১৯৮ মিলিয়ন ডলার আয় করিতেছে। স্বাভাবিকভাবেই কর্মসংস্থানের দিক হইতেও এই খাত উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাইতে পারিতেছে না। সরকারি তথ্য বলিতেছে– বর্তমানে মাত্র ১৫ লক্ষ মানুষ সরাসরি এই খাতের সহিত যুক্ত। দেশের পর্যটন খাতে আমাদের এহেন পরিস্থিতির নেপথ্যে যে নিরাপত্তাবিষয়ক ঘাটতি অন্যতম, তাহা ব্যাখ্যা করিবার জন্য বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই। উহার সহিত অবকাঠামোগত সুরক্ষাও বিবেচনা করিতে হইবে বৈকি। নিছক নির্দেশক কিংবা গাইড না থাকিবার কারণে যেইভাবে বিভিন্ন সময়ে পর্যটকগণ সাগরে ডুবিয়া প্রাণ হারান, উহা গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না।
আমরা জানি, জাতিসংঘের যে সকল টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার সচেষ্ট, তন্মধ্যে অন্তত তিনটি পর্যটনের সহিত সরাসরি সম্পর্কিত। অর্থাৎ পর্যটনকে উপেক্ষা করিয়া দেশে যত উন্নয়নই হউক, তাহা টেকসই হইবে না। সম্ভবত এই কারণেই সরকার ইতোমধ্যে পর্যটন খাতের উন্নয়নে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করিয়াছে। তবে আশ্চর্যজনক হইলেও সত্য, গত বছর প্রণীত পর্যটন পুলিশের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ঐ মহাপরিকল্পনায় উক্ত বাহিনীর কোনো স্থান হয় নাই।
আমরা প্রত্যাশা করি, পর্যটন পুলিশের সেবার মান ও পরিধি বাড়াইতে সংস্থাটির পক্ষ হইতে যে ২০টি সুপারিশ করা হইয়াছে, ঐগুলি সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের নিকট যথাযথ গুরুত্ব পাইবে। কিন্তু উহাই যথেষ্ট নহে; যাইতে হইবে আরও অনেক দূর, অনেককে লইয়া।
মন্তব্য করুন