নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা চলাকালে খাতা না দেখানোয় সহপাঠীদের হাতে খুন হয় সুমন (১৫)। এ ঘটনার কয়েক দিন পর তার বাবা ১২ জনের নামে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ তদন্তের পর ১০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর ইউনিয়ন পরিষদে সালিশ বৈঠক বসিয়ে ১৫ লাখ টাকায় মামলা রফা করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান। গত শনিবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়ন পরিষদে এ ঘটনা ঘটে।

এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা বলছেন, হত্যা মামলার বিচার এভাবে করলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। সমাজে সহিংসতা বাড়বে।

হত্যার শিকার সুমন বেলতৈল গ্রামের সুলতান প্রামাণিকের ছেলে। সে বেলতৈল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। ২০২২ সালের ১২ জুন বিদ্যালয়ে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার সময় তার খাতা দেখতে চায় ২-৩ জন সহপাঠী। সুমন খাতা না দেখানোয় তারা ক্ষুব্ধ হয়। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিন সহপাঠীর নেতৃত্বে কয়েকজন সুমনের পথরোধ করে হামলা চালায়। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুন তার মৃত্যু হয়। ২৪ জুন সুমনের বাবা শাহজাদপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। এর পর সুমন হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে এলাকায় মানববন্ধন করেন স্বজন ও গ্রামবাসী। মানববন্ধনে উপস্থিত ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামও হত্যার বিচার দাবি করেন।

জানা গেছে, বিবাদীরা প্রভাবশালী। তাঁরা ও ইউপি চেয়ারম্যান মিলে বাদীপক্ষকে চাপ দেন। এর পর শনিবার লোকজন নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে সালিশে বসেন বেলতৈল ইউপির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। বাদীপক্ষকে চাপ দিয়ে এবং নানা কৌশলে বাগে এনে বিবাদীকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করে বিষয়টি আপসের নির্দেশ দেন তিনি। আর এ বিষয়ে রায় ঘোষণা করেন হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল মাজেদ। সালিশ বৈঠক আহ্বান করেন বেলতৈল ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুস ছালাম রাজা। ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এতে আরও উপস্থিত ছিলেন জালালপুরের আব্দুর রশিদসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি।

১৫ সদস্যের বোর্ডের পক্ষে রায় ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মাজেদ। এ সময় তিনি বলেন, শিশুরা হত্যা করেছে, এটি সত্য। বাদীর পারিবারিক অবস্থা ভালো না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা আলোচনা করে ১২ আসামিকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করেছি। এই টাকা বাদীকে দেওয়া হবে।

সালিশ বৈঠকের আহ্বায়ক ইউপি সদস্য আব্দুস ছালাম রাজা বলেন, আসামিদের ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এভাবে হত্যা মামলার বিচার করা যায় কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আইনকানুন জানা নেই।

এদিকে প্রভাবশালীদের ভয়ে মুখ খুলছে না বাদীপক্ষ। অনেক চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরে কল করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মাজেদ বলেন, চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বিষয়টি মীমাংসা করেছেন তিনি। কিন্তু আদালত যে রায় দেবেন, সেটাই মানতে হবে।

আইনজীবী আনোয়ার হোসেন বলেন, গ্রাম্য সালিশে এভাবে কোনো চেয়ারম্যান হত্যা মামলার বিচার করতে পারেন না। এ ধরনের আইন বাংলাদেশে নেই। কেউ যদি এমন করে থাকেন, তাহলে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার ও অন্যায় করেছেন।

এ বিষয়ে শাহজাদপুর থানার ওসি নজরুল ইসলাম জানান, সালিশ বৈঠকে যেটাই করা হোক, মামলা তো আদালতে বিচারাধীন। তাই আদালত যে রায় দেবেন, সেটাই মানতে হবে।