- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- ঔদাস্যের অবকাশ নাই
ঔদাস্যের অবকাশ নাই
দেশব্যাপী চলমান মাধ্যমিক পর্যায়ের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় প্রায় ৩৮ সহস্র শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি উদ্বেগজনক বলিয়া আমরা মনে করি। রবিবার প্রকাশিত সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে ইহা স্পষ্ট, দুইটি কারণে শিক্ষার্থীরা এই পর্যায় হইতে ঝরিয়া পড়িয়াছে– দারিদ্র্য ও বাল্যবিবাহ; যাহার অর্থ হইল অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ছাত্রী। আমাদের উদ্বেগের কারণটিও এইখানেই নিহিত।
প্রথমত, সমাজের দরিদ্র অংশ এমনিতেই নানা বৈষম্যের শিকার; শিক্ষার ধারা হইতে ঝরিয়া পড়ার ফলে উক্ত শিক্ষার্থীরা চাকুরির বাজারে ধনীর সন্তানদের তুলনায় আরও পিছাইয়া যাইবে। দ্বিতীয়ত, তাহাদের অধিকাংশ নারী হওয়ায় সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাইবে। আর উভয়েরই পরিণামে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সমাজকেই ভুগিতে হইবে। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, এই ঝরিয়া পড়া শিক্ষার্থীদের অনেকে যুক্ত হইয়াছে শিশুশ্রমে–যাহা শুধু সংশ্লিষ্ট শিশুর শৈশব কাড়িয়া লয় না, আন্তর্জাতিক পরিসরে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতেও আঘাত হানে; যেই কারণে বিশেষত গত কয়েক দশক ধরিয়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় সরকার এই দেশ হইতে শিশুশ্রম দূর করিবার জোর চেষ্টা চালাইতেছে।
অন্যদিকে, বাল্যবিবাহের কারণে শুধু সংশ্লিষ্ট নারী শিক্ষার্থীরাই শারীরিক-মানসিক ক্ষতির শিকার হইতেছে না, রাষ্ট্রও বঞ্চিত হইতেছে সক্ষম নারী জনশক্তির সেবা হইতে। উপরন্তু, বাল্যবিবাহের শিকার নারী যেই কারণে কালক্রমে বহুবিধ স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগে তাহা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও চিকিৎসা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করিতে হয়।
আমরা জানি, দারিদ্র্য এবং বাল্যবিবাহ উভয় সংকটের প্রভাবে প্রতি বৎসরই মাধ্যমিক শিক্ষা হইতে অনেক শিক্ষার্থী ঝরিয়া যায়। কিন্তু এই বৎসর পরীক্ষা চালাকালে অনুপস্থিতির যেই হার দেখা যাইতেছে, উহাকে স্বাভাবিকভাবে লইবার অবকাশ সামান্যই। প্রতিবেদন মতে, ২০১৭ সালের চাইতে এইবার পাঁচগুণের কাছাকাছি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত; এবং অন্তর্বর্তী সময়ে যেহেতু করোনা মহামারি ধাক্কা দিয়াছে, ধারণা করা স্বাভাবিক– উহার প্রভাবেই বস্তুত মাধ্যমিক শিক্ষায় এই বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়াছে। দুঃখজনক হইল, করোনার প্রভাব হ্রাস পাইবার পরপরই বিষয়টির প্রতি বিশেষত শিক্ষানুরাগী মানুষেরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন, যাহা অনেকাংশেই উপেক্ষিত হইয়াছে। সম্ভবত এই কারণেই–বিস্ময়করভাবে–আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান মোট পরীক্ষার্থীর এক থেকে দেড় শতাংশ অনুপস্থিতির বিষয়টিকে উদ্বেগজনক নয় বলিয়াছেন। আমরা মনে করি, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ মানিয়া সেই সময় যদি উপযুক্ত সমীক্ষার ভিত্তিতে করোনার অভিঘাতে ঝরিয়া পড়া শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করিয়া শিক্ষার ধারায় ফিরাইয়া আনা হইত তাহা হইলে আলোচ্য সমস্যার সৃষ্টি হইত না। এই পর্যায় হইতে একজন শিক্ষার্থীও যদি ঝরিয়া যায়, তাহার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়া দেখিতে হইবে। তাই এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ৩৮ সহস্র শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি সম্পর্কে ঔদাস্যের অবকাশ নাই।
সরকারের সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখনও প্রায় উনিশ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য এবং ইহাদের মধ্যে বড় অংশ অতিদারিদ্র্য। এই সকল পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিতে সরকার ও সমাজকে বিশেষভাবে আগাইয়া আসিতে হইবে। একইসঙ্গে বাল্যবিবাহ কমানোর বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়া দেখিতে হইবে।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত ইউনিসেফের হিসাবে দেখা গিয়াছে, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বে অষ্টম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ অবস্থানে রহিয়াছি। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের ভালো অবস্থান থাকিবার পরও বাল্যবিবাহ রোধে আমরা পিছাইয়া রহিয়াছি। ঐ সময় এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা লিখিয়াছি, কোনো মেয়ে যাহাতে শিক্ষা হইতে ঝরিয়া না পড়ে, সেই দিকে সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সচেষ্ট হইতে হইবে।
মনে রাখিতে হইবে, শিক্ষায় ঝরিয়া পড়া কিংবা বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ যেই দারিদ্র্য সেই দারিদ্র্য দূর করিবার অন্যতম উপায় হইলো শিক্ষা। অতএব সকল বাধা দূর করিয়া সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করিতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।
মন্তব্য করুন