শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ছিলেন নির্ভীক, দৃঢ়চেতা, দায়িত্ববান, পরিশ্রমী, সৎ, আদর্শবান, ধার্মিক, কর্মী বান্ধব, সৃষ্টিশীল ও দূরদর্শী এক জননন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। মাতৃভূমির একাধিক চরম দুঃসময়ে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের পথে সব অনিবার্য সমস্যা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাহস, দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা তিনি অর্জন করেছিলেন অপার দেশপ্রেম এবং দায়িত্ব পালনের নিষ্ঠা থেকে। তিনি জনগণকে ভালোবেসে তাদের কল্যাণে আন্তরিক ছিলেন বলেই জনগণ অন্তর দিয়ে তাঁকে ভালোবেসেছে। তাঁর আদেশ, অনুরোধ, পরামর্শ গ্রহণ করেছে এবং উপকৃত হয়েছে।

শহীদ জিয়ার সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা তাঁর সাথী হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই তাঁর গুণমুগ্ধ হয়েছেন। দেশ ও মানুষের কল্যাণে সহযোদ্ধা-সহকর্মী হয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন। বন্ধু কিংবা অনুরক্ত হয়েছেন। নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে, দৃষ্টান্তমূলক ব্যক্তিজীবন দিয়ে অর্জনযোগ্য উন্নয়ন অভিযাত্রায় তিনি পাশে পেয়েছিলেন দেশ-বিদেশের অগণিত মানুষকে। আর যা কিছু তাঁর নিজের ছিল এবং যা কিছু তিনি অর্জন করেছিলেন, তার সবটাই নিবেদন করেছেন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য।

নিজের কিংবা পরিবারের জন্য জিয়াউর রহমান কিছুই রাখেননি। এমন একজন মহাপ্রাণ দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা, মাতৃভূমিতে শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী, দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির সোপান রচনাকারী, মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ ফসল বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকারী এবং বাসযোগ্য ও মর্যাদাবান একটি রাষ্ট্রের গঠিত নাগরিক হতে প্রবল আগ্রহী জনগণের নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শনকারী মানুষটির নাম জিয়াউর রহমান।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে আমরা হারিয়েছি এমন এক সময়ে, যখন দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণপ্রত্যাশী জনগণ তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে উন্নয়ন ও শান্তি অর্জনের কর্মযজ্ঞে সক্রিয় এবং নিশ্চিত ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত ছিল; দেশ-বিদেশে যখন বাংলাদেশ মর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করতে শুরু করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ১৯৮১ সালের ৩০ মে শুধু জিয়াউর রহমানকে কেড়ে নেয়নি; এ দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির জোয়ারও থামিয়ে দিয়েছিল। লাখ লাখ অশ্রুসিক্ত মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত জানাজা যে অতুলনীয় মর্যাদায় তাঁকে অভিষিক্ত করেছে, তা অতিক্রম করার সৌভাগ্য আর কারও হবে কিনা– এটি শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জিয়ার অবদান নিয়ে রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে জেনে না-জেনে কিংবা বুঝে না-বুঝে কিছু মানুষ ভিত্তিহীন কথা বলে নিজেরাই নিজেদের ছোট করেন। কে না জানে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পর কোন সাহসী সৈনিক অবাঙালি প্রতিপক্ষের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে প্রথম ঘোষণা করেছিলেন– ‘উই রিভোল্ট’ বা ‘আমরা বিদ্রোহ করলাম’? কে অস্বীকার করবে এ দেশের কোন বীর সন্তান পাকিস্তানি কমান্ডার ও তার সাথীদের প্রথম বন্দি করে, হত্যা করে স্বাধীনতার জন্য নিজ বাহিনীকে উদ্বুব্ধ ও প্রস্তুত করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছিলেন? কে প্রথম একটি সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানিদের সম্মুখযুদ্ধে মোকাবিলা করেছেন? কার প্রতিরোধ যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ‘স্টালিনগ্রাদ’ প্রতিরোধের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন? কার নেতৃত্বে প্রথম সেক্টর অনানুষ্ঠানিকভাবে গড়ে উঠেছিল? কোন সামরিক কর্মকতা দেশের দুটি সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব (সাময়িক) পালন করেছেন? কোন সামরিক কমান্ডারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্ত এলাকায় প্রথম বাংলাদেশের ‘বেসামরিক প্রশাসন’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; যেখানে প্রশাসন, পুলিশ, আদালত, ডাকঘর, জেলখানা, রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা ছিল? তিনি মেজর জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনন্য অবদান জাতি ভুলবে কীভাবে? যাঁর যা প্রাপ্য, তা না দেওয়া হীনম্মন্যতা ও অপরাধ। দেশে সুস্থ রাজনীতির বিকাশ এবং জনগণের স্বার্থে গঠনমূলক রাজনৈতিক চর্চার জন্য এর অবসান সময়ের দাবি এবং অনিবার্য।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞে বিপর্যস্ত এ দেশের জনগণ একাত্তরের ২৭ মার্চ প্রথমবার ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ শুনে যেমন উদ্দীপ্ত হয়েছিল, মনে সাহস পেয়েছিল; ঠিক তেমনি ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর দেশের আরেক ভয়াবহ দুঃসময়ে ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি’ শুনে আশ্বস্ত ও নিশ্চিত হয়েছিল। সবাই এসব সত্য জানে বলেই শহীদ জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলা যায়নি। তাঁর রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। হবেও না; হয় না কখনও।

শহীদ জিয়াউর রহমান একজন মানুষ ছিলেন। আর মানুষ হিসেবে আমরা কেউই ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নই। ভ্রান্তির সমালোচনা– তা ব্যক্তির হোক কিংবা রাজনীতি অথবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের– হতেই পারে। কিন্তু কখনও তা সত্যকে অস্বীকার করে নয়।

আজ বাংলাদেশের যা কিছু গৌরবের, তার মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্প, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, কৃষির উন্নয়ন কিংবা বিদ্যুৎ। এসব নিয়ে গৌরব করতে হলে যিনি এগুলোর সূচনা করেছিলেন; সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর ঈর্ষণীয় দূরদৃষ্টি দিয়ে, সেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদান অস্বীকার করা শুধু অযৌক্তিক নয়; অপরাধ।

অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি, নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি কি শহীদ জিয়ার রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টির প্রমাণ হিসেবে সম্মানিত হাওয়ার যোগ্য নয়? তিনি বন্ধ শিল্প চালুর পাশাপাশি নতুন শিল্প গড়ে তোলেন। তাঁর শাসনামলে কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটানো হয়। উৎপাদন বাড়ানো হয়। বেকার জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা হয়।

জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই দেশে পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনিই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে সাড়ে আট হাজার জনশক্তি রপ্তানি করেন, যা আজ প্রায় সোয়া কোটিতে পরিণত হয়েছে। এই জনশক্তি দিয়ে আজ দেশে ১৮ বিলিয়ন এবং পোশাকশিল্প দিয়ে ৪০ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হচ্ছে। পোশাকশিল্পের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ৭০ শতাংশ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।

জিয়াউর রহমান গ্রামে শিল্পের মাধ্যমে উন্নয়নে পল্লী বিদ্যুতায়নের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন। বাপেক্স গঠন করেছেন। বঙ্গোপসাগরে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ মাছ রপ্তানি শুরু করেন। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গিনিতে চাল রপ্তানি করেছেন। চিনি রপ্তানি করেছেন। জিয়া শুধু কৃষক ও শ্রমিকদের উন্নয়নে উৎপাদনের রাজনীতি করেছেন। যুব ও নারীশক্তিকে সমৃদ্ধ করেছেন। যুব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করেছেন।

জিয়াউর রহমানই প্রথম উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি শুরু করেন। এ মন্ত্র দিয়েই তিনি বিএনপি গঠন করেন। যা কিছু উৎপাদনের পক্ষে, সেটাকেই তিনি গ্রহণ করলেন। সেচ, সার, আর্থিক সহায়তা, বীজ সংরক্ষণ; সর্বোপরি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের উদ্দীপ্ত করে যিনি খাদ্যোৎপাদন বাড়িয়েছেন, তাঁকে শ্রমিক, কৃষকের কাছে জনপ্রিয় করা নিষ্প্রয়োজন। এসব ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় অপপ্রচারে যতই অর্থ ও ঘাম বিনিয়োগ করা হোক, লাভ হবে না।

আজ ব্যাংক লুটেরা, অর্থ পাচারকারী, সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে যারা জনগণের জীবন-জীবিকা দুঃসহ করে তুলেছে; দুর্নীতি ও অনিয়ম করে কয়েক হাজার নব্য ধনী সৃষ্টি করেছে; এদের প্রতিরোধে শহীদ জিয়ার স্মৃতি ধারণকারী ও আদর্শের অনুসারী;  অত্যাচার, শোষণ ও অপশাসনে অতিষ্ঠ শহর-গ্রামের কোটি কোটি মানুষ প্রস্তুত হচ্ছে। তারা ভোটে নির্বাচিত এবং তাদের কাছে দায়বদ্ধ সরকার চায়। আর সে কারণেই চায় প্রকৃত গণতন্ত্র, যা তাদের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, যোগ্য ও সৎ মানুষদের নির্বাচিত করার সুযোগ দেবে। এই ক্ষমতা তাদের প্রাপ্য এবং এটি তারা অর্জন করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে।

শোকের এই দিনে শহীদ জিয়াকে স্মরণ করি।

নজরুল ইসলাম খান: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য