বলা হয়, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা বুদ্ধি খাটিয়ে ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসতে পারেন। কিন্তু আক্কেলঅলা লোক, মানে জ্ঞানী মানুষেরা ফাঁদ এড়িয়ে চলতে পারেন। খাটো বুদ্ধির মানুষ বুঝতেই পারেন না, কোনটা ফাঁদ আর কোনটা কী।

ফাঁদ পাতা হয়েছে। পা দেবেন কি দেবেন না, তা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার। যাঁদের মনে কু ডাক বাজে, তাঁরা সাবধান হলেই হয়। যাঁরা যে কোনো কিছুর চাইতে শক্তিশালী তাঁদের কথা আলাদা। কিছুতেই তাঁদের কিছু হবে না– এই বাজি তাঁরা ধরতে চাইতে পারেন। তবে ২০২৩ সালের মে মাসের পর বাস্তববোধঅলা কোনো মানুষ মনে হয় না তাঁদের পক্ষে বাজি ধরতে রাজি থাকবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই একটি ফাঁদ। ফাঁদ পাতা হয়েছে বটে, তবে পথ তো খোলা আছে। অসম্ভব সরল সেই পথ। ফাঁদ পাতা পথে না যাওয়া। কিন্তু যাঁরা দিন-রাত ক্ষমতার টনিক সেবন করেন, তাঁরা সরল সত্যটা দেখতে পান না। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, ক্ষমতাধরদের চিন্তার ট্রাফিক আলাদা। আলাদাই যদি না হবে, তাহলে এত এত ক্ষমতা সত্ত্বেও কেন একটা সময়ে তাঁদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়!

এই দেশে ২০০৬-২০০৮ সময়ে একটা জরুরি অবস্থা বিরাজ করেছিল। এর পরিকল্পনাকারীরা যা চেয়েছিলেন তার সরল পরিভাষা ছিল– মাইনাস টু। বহু আয়োজন-এন্তেজাম, অঢেল বিদেশি রসদ খাটিয়েও সেই ফন্দি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তা একেবারে ব্যর্থও হয়নি। মাইনাস টু-এর অর্ধেক কর্মসূচি চলমান, যার নাম হলো মাইনাস ওয়ান। রাজনীতি অবাধ ও গতিশীল থাকা অবস্থায় তো কোনো বড় দল বা প্রভাবশালী নেতাকে ‘মাইনাস ওয়ান’-এর কোপে ফেলা যায় না। তাই রাজনীতিকেও অবরুদ্ধ করতে হয়েছে, যার পরিণাম হলো ভারসাম্যহীন একচেটিয়া ক্ষমতা এবং বিরাজনৈতিকীকরণের ঝুঁকি।

সংসদ, জনমত এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হয়েছে, বলা যায় না। পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। বিরোধী দলের জন্য মাঠে খাদ কেটে রাখা হয়েছিল। বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী নির্যাতিত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন বা জেল খাটছেন। অনেকে দেশ ছাড়তে অথবা রাজনীতি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এ রকম একদলীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজনৈতিকীকরণের জন্য সোনায়-সোহাগা হয়। দৃশ্যত রাজনৈতিক দলই সরকার পরিচালনা করেছে। কিন্তু কাজকারবার যা হয়েছে তা আমলা-বিশেষজ্ঞদের হাত দিয়েই। ভয়ের দাপটে সত্য ভাষণ মাটির তলায় চলে গেছে। বিকল্প নেতৃত্বের সম্ভাবনা বেজায় কমজোরি হয়ে গেছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনও যদি ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হয় তাহলে ক্ষমতার চূড়ান্ত একচেটিয়াকরণ ঘটে যাবে। দেশে ‘না’ বলার কোনো লোক পাওয়া যাবে না। এমনকি বিরাজনৈতিকীকরণও সম্পূর্ণ হয়ে যেতে পারে। এক দল এক নেতা এক স্লোগানের দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা হবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো। স্বদেশ থেকে বিতাড়িত এবং নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই দেশের মানুষ রাষ্ট্রের অধিবাসী হবে ঠিকই; কিন্তু রাষ্ট্রের ওপর তাদের কোনো হিস্যা থাকবে না। দলই তখন হয়ে উঠবে রাষ্ট্র। সংবিধান, জনমত, সংসদ, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি তখন কার কাজে আসবে, তা বুঝতে গত এক যুগের পরিস্থিতির দিকে তাকালেই চলবে।

এই বিপদের দিকে দেশ একাই যাচ্ছে না; ক্ষমতাসীনরাও যাচ্ছে বলে ভয় হয়। কিন্তু অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন তো আওয়ামী লীগের জন্যও জরুরি। সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ছাড়া দলের ভেতর কথিত ‘কাউয়াদের’ ক্ষমতায়ন ঠেকানো যাবে না। দলীয় সংগঠনের পুনরুজ্জীবন হবে না। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকেরা দলের পদ পাবেন না। জাতীয় সংসদে যাঁরা বসবেন, তাঁরা যদি সত্যিকার জনপ্রতিনিধি না হন, তাহলে দলের বিশ্বস্ত প্রতিনিধিরা কোথা থেকে আসবেন? আমলাতন্ত্র আর বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দেশ পরিচালনাকে আর যা-ই হোক, রাজনৈতিক সুশাসন বলা যায় না। বিপুল জনপ্রিয় দলের অপমৃত্যুর এটিই সবচেয়ে খারাপ পথ। সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে মুসলিম লীগ নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। একদলীয় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ ২৩ বছর ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিল। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করার খেসারত বিএনপিকে এখনও দিতে হচ্ছে। বাঘের পিঠে চড়ে বসলেই হবে না, নামতেও জানতে হবে। চিরকাল ব্যাঘ্রসওয়ারি থাকাও তো অস্বাভাবিক পছন্দ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দান এখন মাইনফিল্ড হয়ে আছে। কোথাও কোন ভুল পদক্ষেপে বিস্ফোরণ ঘটবে, কেউ বলতে পারে না। অর্থনীতি বিপর্যস্ত। সমাজের ভেতর অনেক অসন্তোষের বারুদ। দলের ভেতর কোন্দল। প্রশাসনের অনেকেই নিজের নাক ছাড়া আর কিছু বাঁচাতে অনিচ্ছুক। বিভিন্ন রকম চরমপন্থি সুযোগের অপেক্ষায়। এ রকম ছন্নছাড়া ও নাজুক দশা নিয়ে অতীতের কায়দায় নির্বাচনের আয়োজন করতে যাওয়া মানে মৌচাকে ঢিল মারা।

দ্বিতীয় পরিস্থিতি বহিরাগত। ভূ-রাজনৈতিক ত্রিশূলের তিনটি শূলই বাংলাদেশকে নানাভাবে বিদ্ধ করছে। যে কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়া হবে ‘মিশন ইম্পসিবল’। এমন সংকট ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা না করা মানে কোনো এক পক্ষে ঝুলে পড়া। আমাদের দুটি রাজনৈতিক ধারা একে অন্যকে যে চোখে দেখে, তা সেই কৃষকের গল্প মনে করায়।


কৃষক দৈবের কাছে বর চেয়েছিল। দৈব প্রায়ই উদার হয়। কিন্তু সেই উদারতার সঙ্গে ‘শর্ত প্রযোজ্য’ বলে একটা প্যাঁচ লাগানো থাকে। দৈব তাকে বলল– ‘যা চাও তা-ই পাবে। তবে শর্ত হলো, তুমি যা পাবে, তোমার প্রতিবেশী পাবে তার দ্বিগুণ।’ এক টুকরা জমি নিয়ে প্রতিবেশী কৃষকের সঙ্গে তার বংশানুক্রমিক বিবাদ। তো, অনেক ভেবে-চিন্তে বৌয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে কৃষক বর চাইল– ‘হে দৈব, তুমি আমার এক চোখ অন্ধ করে দাও।’ বলল, আর মনে মনে নিজের তারিফ করল। দ্যাখলে তো, কেমন প্যাঁচ খেললাম! আমার জমি নিয়ে টানাটানি করো, এবার মজা বোঝো! দৈব তা-ই করল। ফলে দুই কৃষকের তিনটি চোখ নষ্ট হলো। একজন এক চোখে দেখে, আরেকজন কিছুই দেখে না। ফাঁদ কিন্তু উভয়ের জন্যই অপেক্ষা করে।
সুতরাং আমরা যারা পরাশক্তিগুলোর কাছে বর চাইছি, তাদের শর্তটা যেন আমরা না ভুলি। দিনের শেষে যে এক চোখে দেখে, তাকে বলে একদেশদর্শী। যে অন্ধ, সে তো পথই চেনে না। চোখের বদলা চোখ নিতে গিয়ে মানব জাতি বহুবার নিজের সর্বনাশ করেছে। ক্ষমতা চাইলে গণতন্ত্র চাইব, না হলে ক্ষমতা ও গণতন্ত্র দুটিই গভীর জলে ডুবতে পারে। আবার, গণতন্ত্র চাইব কিন্তু প্রতিপক্ষের বিনাশও চাইব– তা হয় না। পরস্পরের বিনাশের ‘মাইনাস টু’ থিওরির ইতি টানতে হবে এখনই।

কীভাবে সম্ভব? উদাহরণ আমাদেরই হাতে তৈরি করা। সম্প্রতি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন সম্ভব।’ সেটি সম্ভব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের ভেতর থেকেই। সেখানে অন্তর্বর্তীকালের জন্য এমন ব্যবস্থা রাখা যাবে বলে সুপারিশ করা ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘মাইনাস টু’ করতে চেয়েছিল। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নির্বাচনকালীন সরকার থাকলে কোনো একটি পক্ষ অন্যপক্ষকে অনৈতিকভাবে পরাস্ত করার সুযোগ পাবে না। তারচেয়ে বড় কথা, যখন দুটি পক্ষই ‘মরো কিংবা মারো’ নীতিতে চলবে, তখন মধ্যস্থতাকারী ছাড়া এই আত্মঘাতী লড়াই আর কে থামাতে পারবে?

বিরোধীদের হাজারো সমস্যা, কিন্তু আওয়ামী লীগের চাইতে তারা কম নিরুপায়। বিরোধীদের হারার উপায় আছে, ক্ষমতাসীনদের তো সেই উপায়টাও নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে পারে সেই নিরুপায়ের উপায়।

ফারুক ওয়াসিফ: সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক; লেখক
farukwasif0@gmail.com