- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- কোরিয়া উপদ্বীপে উত্তেজনা হ্রাসে করণীয়
পরমাণু কর্মসূচি
কোরিয়া উপদ্বীপে উত্তেজনা হ্রাসে করণীয়

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওন সুক ইওল এপ্রিলের শেষের দিকে হোয়াইট হাউসের একটি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে সত্তরের দশকের গান ‘আমেরিকান পাই’ শোনানোর মাধ্যমে আবেগপূর্ণ এক পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। ইওন সম্ভবত ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার ডন ম্যাকলিনের গানের সঙ্গে পরিচিত নন, যে গানটি শুরু হয়, ‘বাই-বাই, মিস আমেরিকান পাই’ দিয়ে। যেখানে আসলে আমেরিকার মোহভঙ্গের বিষয়টি বর্ণিত হয়। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির সমাধানে মার্কিন ব্যর্থতার বিষয়েও গানটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকের পছন্দ।
উত্তর কোরিয়ার প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) পরীক্ষার সময় একে গুরুত্ব দেওয়া হয়। হোয়াসঙ্গ-১৮ নামে ওই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা হয় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওনের গান শোনানোর ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে। ক্ষেপণাস্ত্রটি মহাকাশে একটি উচ্চ গতিপথ অনুসরণ করে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পৌঁছে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আইসিবিএমের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আঘাত করার সক্ষমতা দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে। সলিড ফুয়েল মিসাইলের সুবিধা হলো, এটি দ্রুততম সময়ের নোটিশে নিক্ষেপ করা যায়।
হোয়াসঙ্গ-১৮ পরীক্ষার সময় উত্তর কোরিয়া বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মিনিটম্যান-৩ মিসাইলের যে সক্ষমতা, সেই একই ক্ষমতাসম্পন্ন হবে এই মিসাইল। পার্থক্য হলো, হোয়াসঙ্গ-১৮কে মিনিটম্যান সাইলোতে আটকে থাকার সময় শনাক্ত করা কঠিন হবে। এর অর্থ, উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি অর্জনের কাছাকাছি রয়েছে, যা প্রস্তুতির অবস্থায় থাকতে পারে এবং জাতিকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ দ্বিতীয়-হামলার সক্ষমতা দিতে পারে।
উত্তর কোরিয়া সম্ভবত আগামী মাসগুলোতে আরও অধিক পরিমাণে পরমাণু পরীক্ষার মাধ্যমে মিসাইল প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। দেশটি একটি দীর্ঘ প্রত্যাশিত পারমাণবিক পরীক্ষাও করতে পারে, যা ২০১৭ সালের পর হবে প্রথম পরীক্ষা। এর পারমাণবিক পরীক্ষাস্থলে টানেল করার কাজ একটি স্যাটেলাইট দ্বারা শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সত্ত্বেও পিয়ংইয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পারমাণবিক শক্তির পরিচিত পথই অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সলিড-ফুয়েল ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি ৬০ বছরেরও বেশি পুরোনো। এটি ভবিষ্যতে উত্তর কোরিয়া অনুসরণ করতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে।
বুধবার পিয়ংইয়ং একটি সামরিক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। তারা এই পর্যায়ে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া বলছে, তারা এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চেষ্টা আবার করবে এবং সম্ভবত তাদের দাবি অনুসারে, মহাকাশযানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক নজরদারির মাধ্যমে এক ধরনের ‘উন্মুক্ত আকাশ’ ব্যবস্থা চালু করবে, যা স্থিতিশীলতায় অবদান রাখবে। যে কোনোদিক থেকে বলা যায়, উত্তর কোরিয়া এখন পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্র। দেশটির অস্ত্রাগারে ৫০-৬০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে এবং কিছু রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরজুড়ে। দেশটি এখনও যা চেষ্টা করছে তা হলো, ওই পারমাণবিক বোমাগুলো তাদের লক্ষ্যের পথে বায়ুমণ্ডলীয় এলাকায় পুনঃপ্রবেশ করে আঘাত হানতে পারে কিনা।
আমরা দেখছি, উত্তর কোরিয়া কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের ছোট বোমা তৈরি করেছে, যা দেশটির প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানকে বিচলিত করেছে। উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক হুমকি এবং ওয়াশিংটনের ভূমিকার প্রতি আস্থার অভাব থাকার কারণে বেশিরভাগ দক্ষিণ কোরীয় মনে করে, তাদের দেশেরও পারমাণবিক অস্ত্রের দিক থেকে সক্ষমতা অর্জন করা উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওনের সফরের সময় ‘ওয়াশিংটন ঘোষণা’ দিয়ে এই চেষ্টাকে অন্যদিক ঘোরানোর চেষ্টা করেছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করতে এবং নিয়মিতভাবে কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক সাবমেরিনের মতো কৌশলগত সম্পদ মোতায়েন করার সময় পরামর্শ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। বস্তুত দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর পারমাণবিক ব্যবস্থাপনার এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওয়াশিংটন সিউলকে তার নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থাপনায় নিরুৎসাহিত করছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সাম্প্রতিক সিউল সফর পিয়ংইয়ংকে ক্ষুব্ধ করেছে। দুই নেতা উত্তর কোরিয়ার হুমকির কথা উল্লেখ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে একমত হন এবং ইওন পরামর্শ দেন, জাপানও ওয়াশিংটন ঘোষণার অংশ হতে পারে। এটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে ওয়াশিংটন ঘোষণার জবাব দেওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দেশটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া এবং সম্ভবত সে জন্য এই মুহূর্তে এর সর্বোত্তম উপায় হিসেবে বিস্ফোরণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চলছে।
বাইডেন প্রশাসনের আর অপেক্ষা করা উচিত নয়। বরং তাদের উচিত উত্তর কোরিয়ার জন্য নতুন একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নীতি পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা উচিত, বিরত রাখা এবং নিষেধাজ্ঞার কৌশল সত্যিই সর্বোত্তম পথ কিনা। কারণ উভয় পক্ষের সামরিক পদক্ষেপগুলো আরও একটি বিধ্বংসী কোরিয়ান যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে।
মনে হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া অব্যাহতভাবে তার পারমাণবিক অস্ত্র আরও বাড়াচ্ছে। যতদিন দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক হুমকি বলে মনে করছে, ততদিন মনে হচ্ছে তারা এমনটি করবে। ইতোমধ্যে বাইডেন প্রশাসন যদিও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই আলোচনার ব্যাপারে সম্মত, তথাপি আলোচনার টেবিলে যাওয়ার জন্য তারা পিয়ংইয়ংকে আকৃষ্ট করতে এখনও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী প্রশাসন অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে অনেক উৎসাহী ও সক্রিয় ছিল। তারা এই অচলাবস্থা ভাঙতে ইচ্ছুক ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টার পরও অবশ্য শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। আপস-মীমাংসা পদ্ধতিতে না যাওয়ার কারণে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি ঝুলে আছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান সংকট আরও বাড়াচ্ছে। ওয়াশিংটনের উচিত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় মনোনিবেশ করা। সে জন্য উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তি বাড়ানোর কার্যক্রমে সাময়িক স্থবিরতা বা পারমাণবিক পরীক্ষার সুবিধা বা চুল্লি ভেঙে ফেলা উচিত।
বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা; যদিও এ ধরনের ব্যবস্থা উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির ক্ষেত্রে কোনো নাটকীয় সমাধান আনবে না। বাস্তবে সুফল পেতে যথেষ্ট সময় লাগবে। তবে এটি বর্তমান অচলাবস্থার চেয়ে সাফল্যের ক্ষেত্রে আরও বাস্তবসম্মত সুযোগ প্রদান করবে। এই মুহূর্তে ওয়াশিংটনের কাছে খুব বেশি বিকল্প নেই। খুব বেশি আকর্ষণীয় না হলেও, তা স্বীকার করা ছাড়া উত্তর কোরিয়ার নিরস্ত্রীকরণ স্বল্প মেয়াদে অর্জন অধরাই থেকে যাবে।
nজন মেরিল ও জন বার্টন: লেখকদ্বয় যথাক্রমে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর কোরিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং স্কলার এবং কোরিয়া ইকোনমিক ইনস্টিটিউটের সম্পাদক; নিকি এশিয়া থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন