- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- সংসদ সদস্য যখন আত্মহত্যা করতে চান...
সমকালীন প্রসঙ্গ
সংসদ সদস্য যখন আত্মহত্যা করতে চান...

ময়মনসিংহ-৩ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে তিনি সবার সামনে ‘বিষ খেয়ে আত্মহত্যা’ করবেন। গত ২৭ মে শনিবার বিকেলে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের ভুটিয়ারকোনা গ্রামে নারীদের নিয়ে এক উঠান বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন (সমকাল, ২৮ মে, ২০২৩)।
বিষয়টি জানাজানি হলে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। কেউ কেউ হাসিঠাট্টা করতেও ছাড়ছেন না। কিন্তু এটি যে মোটেও হাসিঠাট্টার বিষয় নয়, বরং বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থার অনিবার্য ফল– তা একটু চিন্তা করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
নাজিম উদ্দিন আহমেদ শুধু একজন সংসদ সদস্যই নন, তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাও। বিশ্বাস করতে চাই, তিনি একাত্তরের রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে এ-ও বিশ্বাস করতে চাই, নিশ্চয় তিনি শত্রুসেনাদের মোকাবিলায় আত্মহত্যার হুমকি দেননি। আর কেনই বা দেবেন? কোনো সৈনিকই যুদ্ধের মাঠে আত্মহত্যার হুমকি দিতে পারেন না। তিনি হয় মারবেন, নয়তো মরবেন। আত্মহত্যা করেন বা করতে পারেন শুধু দুর্বল মানসিকতার মানুষ। সংকটে যিনি দ্বিধান্বিত, প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলায় যিনি দিশাহীন, তাঁর মাঝে পলায়নের ইচ্ছে প্রবল। কোনো সৈনিক তা করতে পারেন না। আমরা বিশ্বাস করি, কোনো মুক্তিযোদ্ধাই দুর্বল চিত্তের মানুষ ছিলেন না। দেশমাতৃকার জন্যই জীবন বাজি রেখেছিলেন। নাজিম উদ্দিনও তার ব্যতিক্রম নন। তাহলে হঠাৎ তিনি রাজনীতির যুদ্ধে আত্মহত্যার হুমকি দিলেন কেন?
আমাদের দেশে ভোট চাওয়ার তো অনেক তরিকাই আছে– হাতে ধরা; প্রয়োজনে ঘাড় জড়িয়ে ধরা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষভাবে ইউপি নির্বাচনে দেখা যায়, অনেক প্রার্থী ভোটারদের কদমবুসি পর্যন্ত করছেন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জিতে গেলে কোনো প্রার্থী আত্মহত্যা করবেন বলেছেন– এমন তো শুনিনি! এরূপ প্রকাশ্যে আত্মহননের ঘোষণা বা হুমকি কি রাজনীতির কোনো তরিকায় পড়ে? কেন এই আত্মহননের হুমকি?
এটা সুবিদিত, কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই চিরকাল একটা দল ক্ষমতায় থাকবে– এটা কেউ ভাবে না। প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে শোচনীয়ভাবে হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে কংগ্রেস দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার পর এখন বিরোধী দলের স্ট্যাটাসও হারায় হারায় ভাব। এটিই তো স্বাভাবিক। তাহলে নাজিম উদ্দিন আহমেদ কেমন করে বলতে পারেন– বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবেন! রাজনীতি কি টিনএজারদের মতো ‘ভালোবাসা না পেলে গলায় দড়ি দেব’ টাইপের কিছু?
নাজিম উদ্দিনের কোনো দোষ নেই; দোষটা আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের। রাজনীতি চলে গেছে অরাজনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক জ্ঞানবিবর্জিত মানুষের হাতে। এসব মানুষ রাজনীতির ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত নন। কিছু রাজনীতিকের কাছে রাজনীতি ব্যবসা বৈ কিছু নয়। যেমন অতি সম্প্রতি ভোলা জেলা ছাত্রলীগের এক নেতাকে তার ‘অধীনস্ত’ বিভিন্ন ইউনিটের কমিটির পদ ‘নিলামে বিক্রি’ করতে দেখা গেছে। পদ না পেয়ে অনেকেই নিলামের টাকা ফেরত পেতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দ্বারস্থ হয়েছে (সমকাল, ২৭ মে, ২০২৩)। এমন অনেক ঘটনা সারাদেশেই ঘটছে।
অতীতে আমরা দেখেছি, অনেক রাজনৈতিক নেতা দলের স্বার্থে তাঁর সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এখন ঠিক উল্টো। কোনোমতে একটা পদ পেলেই রাতারাতি আলাদিনের চেরাগ এসে যায় হাতের মুঠোয়। ভাগ্যের আঠারো শিকা ছিঁড়ে এক রাতেই। এভাবেই আমাদের দেশে রাজনীতি অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে পড়ে ক্রমেই দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। কে না জানে, মানুষ যখন দেউলিয়া হয়ে যায়, তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে নাজিম উদ্দিনের হুমকিকেও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।
আরও একটি বিষয়। একটা দল যখন দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকে, তখন সে দলের অনেকের মধ্যেই ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ভর করে। ক্ষমতার বাইরে গেলে তাঁরা কীভাবে টিকে থাকবেন– সে কথা ভেবে এক ধরনের ‘ফোবিয়া’ জন্ম নেয়। আমাদের মতো দেশগুলোতে এটি একটু বেশিই। কারণ ক্ষমতায় থাকাকালে অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহারকে তাঁদের প্রাধিকার বিবেচনা করেন। আর সেই প্রাধিকার হারাতে চান না। কোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। কেউ সমালোচনা করতে এলেই তার ওপর চড়াও হন।
শুধু সরকারি দলেই নয়; বিরোধী দলও ফোবিয়ায় ভুগতে পারে। ‘এ’ ভাবে– ‘ও’ ক্ষমতায় এলে ‘আমার’ অবস্থা তো শেষ। ‘ও’ ভাবে– ‘এ’ এলে আমার যাওয়ার কোনো পথ থাকবে না। যে কারণে দেখা যায়, বিরোধী দলের মধ্যেও দলীয় পদ-পদবি নিয়ে সংঘর্ষ, এমনকি প্রাণহানিও ঘটে।
যেমন নরসিংদীতে ছাত্রদলের কমিটিতে পদপ্রাপ্তি নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুইজন প্রাণ হারিয়েছে। সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে, ‘পদবঞ্চিত ছাত্রদলের নেতারা একটি মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় ঘোষিত কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে জেলখানা মোড় হয়ে জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার পথে প্রতিপক্ষ গ্রুপ তাদের ওপর হামলা চালায়। তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে সাদেকুর রহমান ও আশরাফুল নামে দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।’ (সমকাল, ২৬ মে ২০২৩)।
বিরোধী দলের কিছু নেতাকর্মীও বেফাঁস কথা বলার ওস্তাদ। যেমন রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯ মে রাজশাহীর পুঠিয়ায় দলের জনসমাবেশে বলেছেন, ‘আর ২৭ দফা ১০ দফার মধ্যে আমরা নাই। এক দফা– শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠাতে হবে’। (সমকাল, ২১ মে ২০২৩)। তাঁর এই অরাজনৈতিক বক্তব্য দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় তুলেছে এবং তিনি ইতোমধ্যে আটক হয়েছেন।
আসলে আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বে ভুগছে। মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব কাটিয়ে ওঠা যত সহজ, রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব কাটানো তত সহজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন রাজনীতি বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি ও সুস্থ রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ। কাজটি করতে পারেন রাজনৈতিক জ্ঞানসমৃদ্ধ মানুষ। তা না হলে নাজিম উদ্দিনের মতো সংসদ সদস্য কিংবা আবু সাঈদ চাঁদের মতো রাজনীতিকের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন