- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- মণিপুরকে জ্বলতে দিলে ভারতেরই ক্ষতি
প্রতিবেশী
মণিপুরকে জ্বলতে দিলে ভারতেরই ক্ষতি

মমণিপুরের চলমান যেসব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তা স্বাধীন ভারতে জাতিগতভাবে মানুষকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্নকরণের একমাত্র উদাহরণ। সেখানকার মেইতি সম্প্রদায় যখন পাহাড় ছেড়েছে এবং কুকি-জো সম্প্রদায় ইম্ফল উপত্যকা ত্যাগ করেছে, তখন সেখানে জাতিগত বিভাজনের সব কিছু সম্পন্ন। ৩ মে সূচিত এ সহিংসতার মাসখানেক পরও স্পর্শকাতর সীমান্ত রাজ্যটিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
ভারতীয় সেনাবাহিনী বেশ বড় একটি মানবিক বিপর্যয় এড়াতে প্রশংসনীয় কাজ করলেও তারা অসহায়। কারণ তারা ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যায়’ কারও পক্ষ নিতে পারে না। মণিপুর পুলিশও এখন স্পষ্টত জাতিগতভাবে বিভক্ত। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ ২৮ মে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন, তিনি কুকি ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ দমন করতে প্যারামিলিটারিসহ রাজ্যের সব পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করবেন। যদিও কুকিদের একটি দল বর্তমানে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় রয়েছে। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন, বিদ্রোহী হলেও কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রকাশ্য ঘোষণা পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। যদিও কিছু কুকি নেতা বলেছেন, তাঁদের ‘আত্মরক্ষা’ করার মৌলিক অধিকার রয়েছে।
এদিকে মাসখানেক ধরে পাহাড় ও উপত্যকার সীমান্ত গ্রামগুলোতে অশান্তি বিরাজমান। সেখানে জ্বালানো-পোড়ানো ও হত্যাকাণ্ড চলছে। কয়েক দিন ধরে সহিসংসতা আরও বেড়েছে। কাংভাই (চুরাচাঁদপুর), সুকনু (চন্দল), সাইকুল (কাংপোকপি), কাংচুপ (কাংপোকপি), মোরে (টেংনুপাল) এবং সেকমাই (ইম্ফল-পূর্ব) সীমান্তে নতুন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে প্রথম চারটি পাহাড় মেইতি তেঙ্গলদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং শেষ দুটি পাহাড়ে কুকিরা আক্রমণ করেছে।
যদিও মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, রাজ্যটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে; অথচ মণিপুর রাজ্য অস্ত্রাগারটি ২৮ মে উপত্যকার তিনটি স্থান থেকে দ্বিতীয়বার লুট করা হয়েছে– দ্বিতীয় এবং সপ্তম মণিপুর রাইফেলস ক্যাম্প, ইম্ফল এবং থোবলের তৃতীয় ব্যশ্ম আইআরবি ক্যাম্প। কুকিরা টেংনোপাল জেলার একটি থানা লুট করেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এক হাজার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এখনও মেইতি তেঙ্গলদের হাতে রয়েছে। তার মানে উভয় সম্প্রদায়ের কাছে এখনও যথেষ্টসংখ্যক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে।
আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা মেইতি তেঙ্গলরা স্বাধীন মণিপুরের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা গত এক দশক ধরে মিয়ানমার এবং মণিপুর উপত্যকায় লুকিয়ে ছিল। মিয়ানমারে তাদের অবস্থান জান্তাপন্থি।
দৃশ্যত মণিপুরের মানবাধিকার সংকটকে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। মণিপুর সরকার সহিংসতা শুরু হওয়ার দুই মাস আগে মণিপুরের মানুষের কাছ থেকে লাইসেন্সকৃত বন্দুক সংগ্রহ করলেও (যাচাই করার নাম করে) কুকিদের কাছে এখনও যথেষ্ট দেশীয় বন্দুক রয়েছে। তা ছাড়া মণিপুরের মতো সীমান্ত রাজ্যে সীমান্তের ওপার থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের অবাধ প্রবাহ রয়েছে। সে জন্যই মনে হচ্ছে, শান্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তা ছাড়া যখন উত্তর-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং এর কর্মীদের আগে যে সক্রিয় দেখা যেত, এবার তাদের অনুপস্থিতিও সেই শঙ্কা যোগ করছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্যা হলো, সংশ্লিষ্ট জনপদের মানবাধিকার সংস্থাগুলো সামষ্টিক ‘মানবাধিকার’ সুরক্ষার বদলে তারা শুধু নিজেদের সম্প্রদায়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। একইভাবে, উভয় পক্ষ থেকে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকেও সম্পূর্ণরূপে মেরূকরণ করা হয়েছে। সর্বভারতীয় অনেক সংবাদমাধ্যম প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই না করেই স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর করছে।
মণিপুরের সমস্যা সমাধানে এবং সেখানে যে ক্ষত হয়েছে, তা মেরামতে ব্যাপক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কুকি, যারা ১৯১৭-’১৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং সুভাষচন্দ্র বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে সাহায্য করেছিল, তাদের ‘শরণার্থী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মেইতিরা একদা মেইতি রাজা শাসিত ‘নিজ রাজ্যের’ পাহাড়ে জমি কিনতে না পেরে অসন্তুষ্ট।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এখন মণিপুরে সফরে। তাঁর কাঁধে অনেক বড় দায়িত্ব। তিনি ভালো করেই জানেন, মণিপুরের মতো স্পর্শকাতর এলাকাকে দীর্ঘমেয়াদে জ্বলতে দেওয়া যাবে না। সহিংসতা থামাতে মেইতি এবং কুকি নাগরিক সমাজেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মণিপুরে শান্তি আনতে হলে সব পক্ষকেই কিছু ছাড় দিতে হবে।
ডেভিড হানেং : নাগাল্যান্ডভিত্তিক সমাজকর্মী; দ্য কুইন্ট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফজুর
রহমান মানিক
মন্তব্য করুন