- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- গতানুগতিক বাজেট
গতানুগতিক বাজেট
বৃ হস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবৎসরের জন্য যেই জাতীয় বাজেট পেশ করা হইয়াছে, উহাকে এক কথায় গতানুগতিক আখ্যা দিলে অত্যুক্তি হইবে না। প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় সকল কিছুই যেন চলমান অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবৎসরের বাজেটের প্রতিলিপি মাত্র। বিশেষত গত একটি বৎসর ধরিয়া অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে জাতীয় অর্থনীতি যেই গভীর ও বিস্তৃত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করিয়া আসিতেছে, উহার কোনো প্রতিফলন প্রস্তাবিত বাজেটে নাই বলিলেই চলে। স্বীকার করিতে হইবে, সম্ভবত বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের কারণেই প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সংশোধিত বাজেটের তুলনায় জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাইয়াছে। যেইখানে সংশোধিত বাজেট ৬ লক্ষ ৬০ সহস্র কোটি টাকার কিছু বেশি বা জিডিপির ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ, সেইখানে প্রস্তাবিত বাজেট প্রায় ৭ লক্ষ ৬২ সহস্র কোটি টাকা বা জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমান অর্থবৎসরে ৪ লক্ষ ৩৩ সহস্র কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ লইয়া প্রায় সকল মহল হইতে সংশয় প্রকাশের পরও প্রস্তাবিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হইয়াছে ৫ লক্ষ কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণের এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণযোগ্য হইত যদি ইতোপূর্বে প্রদত্ত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে লইয়া রাজস্ব বিভাগকে ঢালিয়া সাজানো হইত। কিন্তু এই সংক্রান্ত কিছুই প্রস্তাবিত বাজেটে নাই।
বিশেষভাবে বলিতে হইবে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে। সাম্প্রতিক সময়ে উহা আক্ষরিক অর্থেই জনজীবন বিপর্যস্ত করিয়া চলিতেছে। গত বৎসর ঘোষিত বাজেটে বলা হইয়াছিল, মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা হইবে। বাস্তবে উহা কয়েক মাস পূর্বে দুই অংকের ঘরে পৌঁছিয়াছিল, যদিও বর্তমানে ৯ শতাংশের বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ ব্যতিরেকেই গত বৎসরের প্রস্তাবটিকে সামান্য বাড়াইয়া বলা হইয়াছে, উহা ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা হইবে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা লইয়াও প্রায় অভিন্ন প্রবণতা নূতন বাজেটে স্পষ্ট। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়া আসিবার’ যেই প্রত্যয় ব্যক্ত করিয়া উহা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হইয়াছিল, এইবার একই কথা বলিয়া একই প্রবৃদ্ধি ধার্য করা হইয়াছে। অথচ এই সময়ে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয় নাই। যেই কারণে অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বাজেট বক্তৃতায় বলিয়াছেন, এই বৎসর প্রবৃদ্ধি হইবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিভিন্ন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দের বিবেচনায়ও প্রস্তাবিত বাজেটে যে উদ্ভাবনীমূলক অভিমুখ নাই– স্বীকার করিতেই হইবে। গত দেড় দশকে দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় রহিয়াছে, বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষেত্রে যাহার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু একই সময়ে দেশে ধনী-দরিদ্র বৈষম্যও যে বিস্তৃত হইয়াছে, উহাও অস্বীকার করা যাইবে না। আমরা জানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় উপযুক্ত বরাদ্দের মাধ্যমে এই বৈষম্য হ্রাস করা যায়। কারণ এই সকল খাতে বরাদ্দ প্রত্যক্ষভাবে সীমিত ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর উপকারে আসে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পূর্বের ন্যায় বাজেটের ১২ শতাংশের নিম্নে রহিয়াছে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ২০২২-২৩ অর্থবৎসর অপেক্ষা সামান্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। আর সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি পায় নাই বলিলেই চলে। যেমন বয়স্ক ভাতার আওতা বাড়িয়াছে মাত্র ১ লক্ষ, আর ভাতা বাড়িয়া ৫০০ টাকার স্থলে হইয়াছে ৬০০ টাকা; বিধবা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতার চিত্রও তথৈবচ। শুধু উহাই নহে; কর শনাক্তকরণ নম্বর টিআইএনধারীমাত্রেই ন্যূনতম ২ সহস্র টাকা কর দিবার যেই বিধান প্রস্তাবিত হইয়াছে, উহার খড়্গ কিন্তু সীমিত আয়ের নাগরিকগণের উপরেই পতিত হইবে।
হতাশার বিষয়, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নিমিত্তে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যেও বাজেটে লক্ষণীয় কিছু নাই। দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় অনেক খাতে পূর্বের সুবিধাসমূহ বজায় থাকিলেও বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ কিছু ইহাতে নাই। তবে আমাদের প্রত্যাশা, আগামী দিনগুলিতে বাজেট বিষয়ে বিভিন্ন মহল হইতে যেই সমালোচনা ও পরামর্শ আসিবে, সেইগুলি বিবেচনায় লইয়া সরকার বাজেটকে প্রকৃতই ‘দরিদ্রবান্ধব’ করিয়া তুলিবে।
মন্তব্য করুন