- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বিএনপির ‘মাই ম্যান’ চর্চার বলি মূল্যবান প্রাণ
রাজনীতি
বিএনপির ‘মাই ম্যান’ চর্চার বলি মূল্যবান প্রাণ

বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে নরসিংদীতে দুটি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গেল। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভাষ্য অনুযায়ী, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও নরসিংদী জেলার আহ্বায়ক খায়রুল কবীর খোকনের সঙ্গে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহীর স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। তাঁরা উভয়েই নরসিংদী সদর আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ স্নায়ুযুদ্ধেরই বলি ওই দুটি প্রাণ।
বিএনপি টানা সাড়ে ১৬ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে। ফলে মূল দল ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন শাখায় সময়মতো সম্মেলন হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে দায়সারাভাবে চলছে দলীয় কার্যক্রম। এ অবস্থায় সরকার পতনের আন্দোলন বেগবান করতে মূল দলের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গত ২৬ জানুয়ারি নরসিংদী জেলা ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর পরই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নরসিংদীতে বিএনপির রাজনীতি।
মঞ্জুর এলাহীর আশীর্বাপুষ্ট জেলা ছাত্রদলের আগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মাইন উদ্দিনকে প্রত্যাশিত সাধারণ সম্পাদক পদ না দিয়ে সিনিয়র সহসভাপতি করায় ক্ষুব্ধ হয় তাঁর কর্মী-সমর্থকরা। গত বৃহস্পতিবার এ পদবঞ্চিত নেতাকর্মীর মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় গুলিতে দু’জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। মাইন উদ্দিন ভূঁইয়ার ভাষ্য, এ ‘ঘটনায় এখনও খায়রুল কবীর খোকন গ্রেপ্তার না হওয়ায় আমাদের উত্তেজিত কর্মী-সমর্থকরা তাঁর বাড়িতে আগুন দিয়েছে।’ যতদিন পর্যন্ত খায়রুল কবীর খোকন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার না হবেন, ততদিন তাঁরা এ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। ‘খায়রুল কবীরকে আমরা নরসিংদীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছি। তারেক রহমানের কাছ থেকে ফয়সালা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না’– বলছেন তিনি।
দুই ছাত্রদল নেতা নিহতের ঘটনায় করা মামলায় খোকন ও তাঁর স্ত্রী শিরিন সুলতানা আসামি। খায়রুল কবীর খোকন ডাকসুর জিএস ছিলেন; এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব। তাঁর স্ত্রী শিরিন সুলতানাও দলটির কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁদের মতো দায়িত্বশীল নেতার কাছে ‘মাই ম্যান’তত্ত্ব বাস্তবায়নের নামে দলের অভ্যন্তরে কোন্দল অনাকাঙ্ক্ষিত।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এসব দলে একই আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ভোটের সময় ঘনিয়ে এলেই দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নেয়। এলাকায় আধিপত্য কায়েম বা টিকিয়ে রাখতে ‘মাই ম্যান’ দিয়ে মূল দলের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনের উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি করার পাঁয়তারা লক্ষ্য করা যায়। নিজ এলাকায় মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেও কোনো কোনো নেতা মূল দল কিংবা সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নীতিনির্ধারণী পদে রয়েছেন। এসব নেতার কারও কারও বিরুদ্ধে ‘মাই ম্যান’দের অগ্রাধিকার দিয়ে কেন্দ্রীয়, জেলা, মহানগর কমিটি গঠনের অভিযোগ রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটিতে বরিশাল ও ফরিদপুরের প্রাধান্যকে আঞ্চলিকতাপ্রীতি বলে অভিযোগ পদবঞ্চিত কারও কারও। এ অভিযোগকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতির বাড়ি একই উপজেলায় বলে জানা গেছে; যেখানে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকেরও বাড়ি। প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে গিয়ে ‘মাই ম্যান’দের অগ্রাধিকার দিয়ে দলীয় কমিটি গঠন করার পরিণামে ত্যাগী কর্মীর পদবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
বিএনপির দলীয় কোন্দলে নরসিংদীর রাজনীতি উত্তপ্ত। দেশের অন্যান্য আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর অনুসারীদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। যে কোনো সময় তা নরসিংদীর মতো বিস্ফোরিত হতে পারে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে অনড়। দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে বারবার তাদের অবস্থান জানিয়ে আসছে। এ অবস্থায় দলটির ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা। খায়রুল কবীর খোকন জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত মুখ। তাঁর নেতৃত্ব যখন একটি জেলার দলীয় পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়; দুর্বৃত্তের হামলায় জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাদিকুর রহমান ও তাঁর কর্মী আশরাফুল হক গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তখন বলতেই হয়– সরকার পতনের আন্দোলনের চেয়ে নিজের ঘর সামলানো জরুরি।
নরসিংদীর চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম চেষ্টা করেও খায়রুল কবীর খোকনের বক্তব্য জানতে পারেনি। মঞ্জুর এলাহী অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সংবাদমাধ্যম জানতে পেরেছে, মঞ্জুর এলাহীর নেপথ্য শক্তি দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির এক সদস্য। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী যেমন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম, তেমনি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম। তাদের কোনো সদস্য যদি গ্রুপিংকে প্রশ্রয় দেন, তাহলে সংঘাত অনিবার্য।
রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যকে জেলা বা মহানগরে পদধারী করার যৌক্তিকতা বোধগম্য নয়। রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। প্রসঙ্গত, এ নেতা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে কারাগারে রয়েছেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির কাউকে স্থানীয় কমিটিতে পদ দেওয়া হলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন। বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম করার অধিকার রাখে। তবে সেই আন্দোলন যেন সহিংসতায় রূপ না নেয়। একই সঙ্গে দলীয় কোন্দলে আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপির বৈধ কর্মসূচি প্রতিরোধের নামে আওয়ামী লীগ সহিংস হলে তাও সমর্থনযোগ্য নয়।
মিজান শাজাহান: সহসম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com
মন্তব্য করুন