
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। সরকার এটাকে বলছে ‘স্মার্ট বাজেট’। কিন্তু নির্বাচনের বছর রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতির প্রস্তাবিত বাজেটে ১৭ শতাংশের বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জোগাড় করতে হবে। বাজেটের ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে জোগান দেওয়া হবে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এটি বাস্তবায়ন করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। আয়-ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার বেশি। এটিও দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন চতুর্মুখী সংকট। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে চলছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়। আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো এলসির দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের দুর্যোগপূর্ণ ও বিশেষ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে একটি বিশেষ ধরনের বাজেট প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এটিও অতীতের মতো সাধারণ এবং কল্পনাপ্রসূত বাজেট।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অনেক রূপকল্পের কথা বলা হয়েছে। আছে নানা অর্জন আর প্রত্যাশার কথা। কিন্তু কোনো বিষয়েই সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বাজেট তো কেবল রূপকল্প নয়; এটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও থাকতে হয়।
সরকার গত এক যুগেও ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে পারেনি। এখন হঠাৎ বাড়িয়ে ফেলবে– এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। বিভিন্ন খাতে ভ্যাট বাড়ছে, যা ধনীদের জীবনমানে কোনো পরিবর্তন না আনলেও গরিবের জীবন ধারণে বড় প্রভাব ফেলে। ব্যাংক থেকে ঘোষিত পরিমাণ ঋণ নিলে দেশের বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। দেশের ব্যাংক খাত এখন নানা দুষ্টচক্রে বন্দি। সুশাসনের ঘাটতি, খেলাপি ঋণের উচ্চ হার, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈন্য নিয়ে অর্থমন্ত্রী কোনো কথা বলেননি।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। এই বাজেট বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে, তাঁরা কতগুলো কল্পিত গল্প শোনাতে চেয়েছেন। অর্থনীতিতে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর সমাধানের উপায় সরলভাবে আসা উচিত। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে গভীর সংযোগ ও সমন্বয় লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন হবে। মুদ্রানীতিতে সবকিছুর সমাধান সম্ভব নয়। এর প্রভাব কোন কোন খাতে কী রকম পড়ে, তার সমাধান সরকারকে রাজস্বনীতির মাধ্যমে বের করতে হবে। সুদহার বাড়িয়ে দিলে সাধারণ মানুষের আয় বাড়বে। ব্যাংকের আমানত বাড়বে। কিন্তু ব্যবসায় যে উৎপাদন খরচ বাড়বে, তার সমাধান সরকারকে ভিন্নভাবে করতে হবে। সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোনো ঝুঁকি ছাড়াই ৭ শতাংশ সুদে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। তাতে বেসরকারি খাত নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ঋণ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে।
ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ। সময়ে সময়ে নানাভাবে ছাড় দেওয়ার পরও গত মার্চে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ব্যাংকারদেরই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত পদপেক্ষ নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। কোনো ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারি হলে নতুন শাখার অনুমোদন না দেওয়া, প্রধান নির্বাহী হিসেবে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন কমিয়ে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। সব ঋণগ্রহীতার ক্রেডিট ইনফরমেশন আরও সহজ করার পাশাপাশি পরিসর বাড়াতে হবে। তাঁদের সব ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে এ তথ্য সংযোজিত থাকবে। নতুন করে কেউ ঋণ নিতে বা বাকিতে পণ্য কিনতে গেলে তথ্য ভেসে উঠবে। উন্নত বিশ্বে এমন নিয়ম রয়েছে। খেলাপিরা কোনো ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না। তাঁদের সামাজিক অনেক সুবিধা বাতিল হয়ে যায়।
বৈশ্বিক সংকটের যুক্তি দেখিয়ে রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে ডলার সংকট কাটবে না। ভোগ্যপণ্য, সেবা, শিক্ষা ও পরিবহন খাতে যা আমদানি হয়, তা খুব বেশি নয়। এসব পণ্য নিয়ন্ত্রণ করে রিজার্ভ খুব একটা সাশ্রয় হবে না। বরং নিয়ন্ত্রণ করায় উল্টো মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। বিদেশে কর্মী পাঠাতে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিদেশ যাওয়ার খরচ ৫-৭ লাখ টাকা হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সরকারকে এ খাতে খরচ কমিয়ে আনতে হবে।
এখন ডলারের অপ্রতুলতার কারণে দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সংকট। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ হিসেবে ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। বড় শিল্পকারখানাগুলোকে কোন দামে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে, আর এসএমই ও বাসাবাড়িতে কোন দামে বিদ্যুৎ ও গ্যাস দেবে, তা সরকারের ভাবার সময় হয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনে যে খরচ হয়, সরকারের সেই খরচেই শিল্পকারখানায় দেওয়া উচিত। এগুলো জনগণের স্বার্থে দিতে হবে।
আবার বাজেট ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করতে হলে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। কর আদায়ে এনবিআরের দুর্বলতা রয়েছে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে। নতুন জরিপের মাধ্যমে উপজেলা শহরের অনেক মুদি দোকানকেও করের আওতায় আনা সম্ভব। এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ঘরে বসেই কর দেওয়া যায়। পৃথিবীর কোনো দেশেই কর কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা হয় না কারও। কারণ দেখা হলেই আন্ডার টেবিল লেনদেনের সুযোগ তৈরি হয়। আমাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু এর সুফল মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণি পাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে যে আয় বাড়ছে, তা কিন্তু সবার নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আবার আয় কমে যাচ্ছে। তাই অসমতা দূর করতে প্রবৃদ্ধির সুফল সবার ঘরে পৌঁছে দিতে হবে।
পৃথিবীর কোনো দেশই ভ্যাটনির্ভর নয়। আমাদের ভ্যাট থেকে বেশি রাজস্ব আদায় হয়। নেপালের মতো দেশে কর-জিডিপি রেশিও ২৩ শতাংশ, ভারতে ১৫ শতাংশ, আর আমাদের মাত্র ৮ শতাংশ। আইএমএফ এখন বলছে, এটা ১৪ শতাংশ হতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে বাজেটে সামাজিক উন্নয়ন ও গুণগত মানে উন্নীত করার প্রচেষ্টা থাকা দরকার। বাজেটে এসএমই শিল্প খাতে নজর দিতে হবে।
বাজেটের খুবই অল্প কিছু ভালো দিক আছে। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির জাঁতাকলে দেশের সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছে। ঘোষিত বাজেট জনগণের সুরক্ষা না দিয়ে বরং ভোগান্তি আরও বাড়াবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
মন্তব্য করুন