
দিন শুরু হয় হালকা নীল রঙের প্লাস্টিকের একটা বোতল থেকে দেড় লিটার পানি পান করে। বোতলটি দেখতে বেশ। পানি পান করতে করতে বোতল প্রস্তুতকারী ব্র্যান্ডের কথা মনে করে তৃপ্তি আসে। ভালো লাগে। বোতলের কাছেই একটি ট্রে। সেখানে কিছু ফলমূল থাকে। ইচ্ছে হলে একটি পেয়ারা বা কলা খেয়ে নেওয়া যায়। ট্রেটিও প্লাস্টিকের তৈরি।
খাবার টেবিলের এক প্রান্তে ল্যাপটপ থাকে। খবরের কাগজের ওয়েবসাইটগুলো দেখি। ভুলেই যাই আমার ল্যাপটপ, কেবল ও মাউস– সবই প্লাস্টিকের তৈরি।
খবর পড়তে পড়তে সকালের নাশতার সময় এগিয়ে আসে। স্নানের আগে দাড়ি কামানোর রুটিন। ভুলে যাই যে আমার শেভিং ক্রিম একটি প্লাস্টিকের টিউবে চাপ দিয়ে বের করতে হয়, আমার রেজর প্রায় পুরোটাই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এবং শেভ করার ব্রাশের পুরোটাই প্লাস্টিক। স্নানঘরে ছড়িয়ে থাকা শ্যাম্পুর বোতল, সাবানের বাক্স, তেলের বোতল, স্নানের ঝরনা– সবই প্লাস্টিকের তৈরি। স্নান সমাপন করে আমি চুল আঁচড়াই। চিরুনিটিও প্লাস্টিকের তৈরি।
এবার নাশতার টেবিলে। পাকা পেঁপের সঙ্গে টক দই মিশিয়ে খাব। দই আসে নারায়ণগঞ্জের এক দুগ্ধখামার থেকে। গোল প্লাস্টিকের বাস্কে সুন্দর করে স্কচটেপ এঁটে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। যেন দই চুইয়ে পড়তে না পারে। আবারও প্লাস্টিক।
নাশতার পর কয়েকটি ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয়। ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুলের স্ট্রিপগুলো সবই প্লাস্টিকের তৈরি। আমি ঠিক দেখেও দেখি না, বুঝেও বুঝি না।
এবার অফিস যাব। গাড়িতে বসে যেদিকেই চোখ পড়ে, সবই প্লাস্টিকময়। তবে নিশ্চিত নই যে একটি গাড়ির কত অংশ প্লাস্টিক এবং কতটা অন্য ধাতুতে তৈরি।
অফিসের সামনে নেমে ফটকের দিকে এগিয়ে যেতেই একটি ফিতা দিয়ে গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডটা ছুঁয়ে দেখি। ফিতা এবং আইডি কার্ড দুটোই প্লাস্টিকের। নিরাপত্তাকর্মী যন্ত্র দিয়ে ব্যাগটা স্ক্যান করেন; সেই যন্ত্রটিও প্লাস্টিকের। তখন মনে পড়ে যে আমার মানিব্যাগের ভেতর ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এবং আরও কয়েকটি কার্ড আছে। সবগুলোই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি।
এবার নিজেকে একটি প্লাস্টিকের বোমা মনে হয়।
আমার ছোট্ট কুঠুরিতে গিয়ে বসি। চোখ পড়ে কয়েকটি বাদাম ও বিস্কুটের কৌটার দিকে। টিফিনে খিদে লাগলে খাওয়ার জন্য। সব কৌটা প্লাস্টিকের তৈরি। ল্যাপটপটা টেবিলের ওপর উঁচু করে স্ক্রিনটা আমার চোখ বরাবর রাখার জন্য একটি যন্ত্র কেনা হয়েছে। সেটিও প্লাস্টিকের।
এই সেরেছে। প্লাস্টিক নিয়ে এত মাথা ঘামালে জীবন চলবে কী করে? আমি তো ভালোই আছি প্লাস্টিকের রাজ্যে। আর চিন্তা করি না। নিজেকে বলি– ‘প্লাস্টিক ছাড়া আমাদের জীবন অচল, প্লাস্টিক নিয়েই বাঁচতে হবে।’
সন্ধ্যায় একটি ব্যায়ামাগারে যাই, হালকা ব্যায়াম করার জন্য। ব্যায়ামাগারের ছেলেটি আমায় প্লাস্টিকের একটি বোতলে পানি এনে দেয়। ব্যায়াম শেষে একটু কমলার জুস চাই। সেটিও পরিবেশন করা হয় একটি পাতলা প্লাস্টিকের গ্লাসে। গল্প আর না বাড়াই।
বাড়ি ফিরে টেলিভিশনে দেখার কিছু না থাকলেও কিছুক্ষণ রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে নাড়াচাড়া করি। দেখি টিভি সেট, কেবল, রিমোট– সবই প্লাস্টিকের তৈরি। ঠিক তখনই জানালা গলে প্লাস্টিক পোড়ানোর মৃদু গন্ধ ভেসে আসে। কাছেই কোথায় যেন গাড়ির টায়ার বা অন্য কোনো প্লাস্টিক পোড়ানো হচ্ছে।
প্রিয় পাঠক, আমার প্লাস্টিকময় জীবনের গল্প পড়তে আপনার একঘেয়ে লাগতে পারে; তবে চিন্তা করে দেখুন, আপনার জীবনও আমার মতোই প্লাস্টিকে বন্দি। প্রতিদিনের ব্যস্ততায় আমরা খেয়াল করি না যে প্লাস্টিক আমাদের জীবনকে কতটা বিপজ্জনক করে তুলেছে।
আমাদের দেশের গবেষকরা অনেক নিরীক্ষায় দেখিয়েছেন যে আমাদের খাদ্য– মাছ, মাংস ও সবজিতে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব রয়েছে। খাদ্যে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব কোন বিপদ ডেকে আনছে, তাঁরা তাও উল্লেখ করে সাবধান করেছেন। আমরা শুনেও শুনছি না।
রুই, তেলাপিয়া, টেংরা, বাটা মাছসহ কৃত্রিম উপায়ে মিষ্টি পানির জলাধারে চাষ করা দেশীয় প্রজাতির ১৫টি মাছের মধ্যে ক্ষতিকারক ক্ষুদ্র প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা থেকে এ তথ্য মিলেছে। গবেষণার জন্য সাভার ও আশুলিয়া বাজার থেকে সংগ্রহ করা মাছে ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাছে প্লাস্টিক পলিমার হাই ডেনসিটি পলিথিলিন, পলিপ্রপিলিন পলিথিলিন কপোলিমার ও ইথিলিন ভিনাইল এসিটেটের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। এসব প্লাস্টিক পলিমার দৈনন্দিন ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল, জুস, শ্যাম্পুর বোতল, প্লাস্টিকের ব্যাগ, কনটেইনার, প্লাস্টিক ও ফোমের জুতা, মোড়ক ইত্যাদি থেকে পরিবেশে প্রবেশ করছে।
প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরু হয়েছিল জীবনকে সহজ করার জন্য। এই ‘উদ্ভাবন’ দেখে আমরাও খুশি ছিলাম– খরচ কমছে, সহজেই সবকিছু করা যাচ্ছে। কিন্তু প্লাস্টিক যে পরিবেশ, প্রকৃতি ও স্বাস্থ্যের জন্য এতসব বিপদ ডেকে আনবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি। এখন আমরা জানি। বিপদের কথা ভাবনায় এলেও তা রোধে কিছু করতে উদ্যোগী হচ্ছি না। কারণ আমরা আরাম চাই।
ক’বছর আগে কাগজে দেখেছিলাম, বুড়িগঙ্গা নদীর নিচে প্লাস্টিক জমে এমনই পাথর রূপ নিয়েছে যে তা খুঁড়ে বের করার কোনো উপায় বাতলানো যাচ্ছে না। সারাদেশে আমরা যে হারে প্লাস্টিক ব্যবহার করি– তা দেখে অন্যান্য নদী, খাল ও পুকুরের কথা চিন্তা করে ভীত হই।
নিজের জীবনযাত্রা যখন মূল্যায়ন করতে বসি, মনে হয় আমরা এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছি যে আর ফেরার পথ নেই। প্লাস্টিক আমাদের এমনভাবে বশীভূত করেছে যে পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
আসলেই কি ফেরার পথ নেই? আছে, অনেক পথ আছে। তবে আমাদের কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞানীদের কথা শোনে না; তারা শোনে না তাই আমরাও শুনি না। বাস্তবতা সামনে এলেই চোখ বন্ধ করি। আমাদের চিন্তা, কাজ ও সিদ্ধান্তগুলো পরস্পরবিরোধী। কোনো কিছু ক্ষতিকর জেনেও যখন আমরা তা ব্যবহার করি, তখন পরস্পরবিরোধীই মনে হয়।
প্লাস্টিক সত্যিই ক্ষতিকর; সত্যিই। আসুন বিজ্ঞানীদের কথা বিশ্বাস করি। সম্মানিত কর্তৃপক্ষ, আপনারাও বিশ্বাস করুন।
ইকরাম কবীর : গল্পকার এবং যোগাযোগ পেশাজীবী
মন্তব্য করুন