- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- ভিসা নীতি নিয়ে আ’লীগের রাজনৈতিক কৌশল
রাজনীতি
ভিসা নীতি নিয়ে আ’লীগের রাজনৈতিক কৌশল

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কয়েকজনের যুক্তরাষ্ট্র সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলো রাজনীতিতে মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল। সরকারের সমালোচনায় মুখর বিরোধী দলগুলো আরও প্রচার করতে থাকে– আরও নিষেধাজ্ঞা আসছে। কেউ কেউ তখন দিনক্ষণও বলে দিয়েছিলেন– গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের আগেই সেটা আসছে। মেঠো বক্তৃতায় এমনও বলা হতে থাকে– আগের নিষেধাজ্ঞায় আওয়ামী লীগের হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে; আসন্নটিতে মেরুদণ্ডও ভাঙবে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও সেই আশঙ্কা ছিল। যে কারণে তারা তখন সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আসছিল।
বাস্তবে মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসেছে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি। সেটাকে প্রথম অবস্থায় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল একই ভাষায় স্বাগত জানালেও এখন উভয়েই সেটাকে পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগের অপরাজনীতির কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এই ভিসা নীতি গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপির ‘আগুন সন্ত্রাস’ প্রতিরোধেই এই ভিসা নীতি। দলটির বক্তব্য, এর আগে বিএনপি যেহেতু ধ্বংসাত্মক তৎপরতার মাধ্যমে দেশের রাজনীতি কলুষিত করেছে, তাই তাদের প্রতিই সতর্কবার্তা এই ভিসা নীতি। অপরদিকে বিএনপির বক্তব্য, বিতর্কিত নির্বাচনের যে রীতি আওয়ামী লীগ তৈরি করেছে, সেটার দাওয়াই হিসেবেই এই ভিসা নীতি।
আসল কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট করে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের রাজনৈতিক ধারার কথা বলেনি। তারা অগ্নিসন্ত্রাসের কথা বলেনি; ভোটে দুর্নীতির কথাও বলেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনবিরোধী সব ধরনের কাজকেই তারা নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে এই ভিসা নীতি এককভাবে কারও জন্যই রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নেই।
এটা ঠিক, গত দুটি নির্বাচন যে বিতর্কিত ছিল– এ বিষয়টি বিএনপি জনগণের কানে দেওয়ার কাজটি সুষ্ঠুভাবে করতে পেরেছে। রাজনৈতিক এই বটিকা জনগণকে ভালোভাবেই গেলাতে পেরেছে। নিরপেক্ষ জায়গা থেকেও অস্বীকারের অবকাশ নেই যে, গত নির্বাচন ছিল প্রশ্নবোধক। এই সত্য বোধ করি আওয়ামী লীগও স্বীকার করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় কী কৌশল নিচ্ছে বা নিতে পারে? এই একটি মার্কিনি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলেও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। তাঁদের ধারণা, অস্ত্রটি রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবেই ব্যবহার করুক না কেন, এতে দেশে প্রচলিত রাজনীতি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে দুটি রাজনৈতিক কৌশল ইতোমধ্যে স্পষ্ট, এর একটি হলো বিএনপিরই অস্ত্র বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার। গত কয়েক দশক ধরে দেশের প্রধান বিরোধী দলটি যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে নানা তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে এসেছে; যেগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের আগের নিষেধাজ্ঞা এবং এখনকার ভিসা নীতির নেপথ্যে সেসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে কাজ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এখন বিএনপিকে ‘সংঘাত-সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী’ হিসেবে উপস্থাপনে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। বিএনপির সাম্প্রতিক কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। যদিও এ ধরনের উদ্যোগের সুযোগ বিএনপির জন্যও উন্মুক্ত।
আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে তাদের রাজনৈতিক কৌশলে আরেকটি পরিবর্তন আনছে। গত ২৮ মে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীকে বলা হয়েছে– এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, যাতে আওয়ামী লীগ আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়। একই সঙ্গে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিএনপিকে কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়া যাবে না। তার মানে, আওয়ামী লীগ যেভাবে বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সমাবেশ ইত্যাদি মাধ্যমে রাজপথে থাকা শুরু করেছে, সেটা অব্যাহত থাকবে। এই মুহূর্তে সাংগঠনিক কার্যক্রমের দিকে নজর কমিয়ে নির্বাচনী রাজনীতির দিকে অধিক মনোযোগ দিচ্ছে দলটি।
দেখা যাচ্ছে, অতি সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থীর বিজয়ের পরও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে খুব একটা উচ্চবাচ্য করা হয়নি। যদিও জাহাঙ্গীর আলমকে নির্বাচনের আগেই বহিষ্কার করা হয়েছিল। নির্বাচনের পর জাহাঙ্গীরের দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারতের পরও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তেমন কিছুই বলা হয়নি। অনেকে ধারণা করছেন, জাহাঙ্গীরের মতো বিদ্রোহীদের ব্যাপারে আপাতত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে আওয়ামী লীগ বিরত থাকছে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা অবশ্য বসে থাকবেন বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে তিনি নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ চিহ্নিত করার জন্য থানাভিত্তিক পর্যালোচনা সভার ডাক দিয়েছেন। তাতে অনুমান হয়, তিনি জাহাঙ্গীর আলমের ময়দান ফাঁকা করে দেবেন না। আবার গত ৪ জুন তাঁকে গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হবে না– তা হলফ করে বলা যায় না। এ ধরনের ‘পকেট’ এলাকা এবং সেখানে আওয়ামী লীগের মধ্যেই কোন্দল ও অন্তর্দলীয় সংঘাত সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে দলটিকে। আর দ্বাদশ নির্বাচনের আগে যেহেতু খুব বেশি সময় নেই; সামনের দিনগুলোয় রাজনীতির মাঠে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। একটি স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলও দেখা দিতে পারে।
নতুন ভিসা নীতির ‘দেয়াল’ অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপি উভয়ের সামনেই রয়েছে। মাঠের আন্দোলন ছাড়া বিএনপি সরকারকে কতটা চাপে ফেলতে পারবে– সন্দেহ রয়েছে। সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে বাস্তবায়নের তেমন কোনো ইতিবাচক ফল আনতে পারেনি বিএনপি। তাহলে ভিসা নীতির পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের ধরন কী হবে বিএনপির? বিষয়টি আওয়ামী লীগের জন্যও চিন্তার। কারণ বিএনপিকে যদি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে তো তাদের আন্দোলনের ধরন সম্পর্কে জানতে হবে। আবার আওয়ামী লীগও যদি আন্দোলন মোকাবিলায় কঠোর অবস্থানে যেতে চায়, তাহলে তাদের সামনেও রয়েছে সেই ভিসার দেয়ালই।
মোস্তফা হোসেইন: শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
মন্তব্য করুন