খেরসনের কাখোভকা ড্যাম এমন সময় ধ্বংস হলো, যখন ইউক্রেন রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছিল। আপাতদৃষ্টে বড় ধরনের একাধিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে ড্যামটি ধ্বংসের কারণে ১৬ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এক জলাধারের পানি খেরসনের রুশ অধিকৃত অংশের ব্যাপক এলাকা ডুবিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এর ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

ড্যামটির ধ্বংস নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে ইতোমধ্যে মস্কো এবং কিয়েভ একে অন্যকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বেশ ভালো রকম প্রস্তুতি নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেছেন: ‘আমরা ইতোমধ্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছি যে, (এটা ছিল) ইউক্রেনের পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃত নাশকতামূলক হামলা।’ তিনি এও বলেন, কিয়েভের লক্ষ্য ছিল যাতে ক্রিমিয়া পানি থেকে বঞ্চিত হয়।

এ ধরনের হামলার নজির রাশিয়ার ইতিহাসে আরও আছে। স্ট্যালিন ১৯৪১ সালে নিপ্রো নদীতে একটি ড্যামে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন আক্রমণকারী জার্মান বাহিনীকে মোকাবিলার কৌশল হিসেবে। রাশিয়া ১৮১২ সালেও নেপোলিয়নের হামলা ঠেকাতে ‘পোড়ামাটি নীতি’ অবলম্বন করেছিল। রাশিয়া চেয়েছিল, ফরাসি বাহিনী যেন বাঁচার জন্য কিছুই না পায় এবং শুধু মস্কোর জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষই দখলে নিতে পারে। অর্থাৎ এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম রাশিয়ার কাছে বরাবরই যুদ্ধ-কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

কিন্তু যে প্রশ্নটি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, নিপ্রো নদীর তীর ছাপিয়ে যে বিপর্যয় নেমে আসছে, তাতে কে লাভবান হবে? ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলোনস্কির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মিখাইলো বলেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। আর তা হচ্ছে, ইউক্রেনের অগ্রাভিযান থামিয়ে দেওয়া। বাঁধটি কোথায় অবস্থিত, তা এই যুক্তির পক্ষে ধারণা তৈরিতে সহজ হবে। এই ব্যাপক বন্যায় নিপ্রো নদীর উভয় তীর প্লাবিত হয়ে ক্রিমিয়ার দিকে দক্ষিণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস করতে পারে। এটি সম্ভবত আগামী কয়েক মাসের জন্য এ অঞ্চলে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ব্যবস্থাকে কঠিন করে তুলবে। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কোনো প্রকার দুর্বল করবে না।

অধিকন্তু এর ফলে ইউক্রেন বাহিনীর জন্য ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার দখলে থাকা ক্রিমিয়া অভিমুখে যাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এই বাঁধটিতে একটি রাস্তা ছিল, যা দিয়ে ইউক্রেন বাহিনী পাল্টা আক্রমণের জন্য খেরসন অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে পারত। নিপ্রো নদীর পানি এখন বন্যায় ফুলে-ফেঁপে আছে। যে কোনো বাহিনীর জন্যই এটি অতিক্রম করা এখন বেশ কঠিন।

ক্রিমিয়াও এখন মনুষ্যসৃষ্ট এ দুর্যোগের ভোগান্তিতে পড়েছে। নোভা কাখোভকা জলাধারটির ওপর তারা সুপেয় পানি ও সেচের জন্য নির্ভরশীল। এটি বন্ধ হওয়ায় গ্রীষ্মে স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদে যে মানবিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব রাখবে, তা এখন নির্ণয় করা যাবে না। এ ঘটনা অর্থনৈতিক দিক থেকে এ ধরনের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে ক্রিমিয়ার প্রতি রাশিয়া কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ– সেই প্রশ্ন তুলবে। এ হামলার আরও বড় উদ্দেশ্য হতে পারে ইউক্রেনে কার্যকর অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদে বাধা দেওয়ার চেষ্টা।

অন্যদিকে ইউরোপে এ ধরনের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান জাপোরিশা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত বছর রাশিয়ার আক্রমণের প্রথম সপ্তাহ থেকেই এটি রাশিয়ার দখলে ছিল। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লির জন্য শীতল পানির সরবরাহ এ হামলার ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। যদিও তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। 

এভাবে অবকাঠামোকে হামলার লক্ষ্য করায় এমনটাও ধরে নেওয়া যায়, রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর পক্ষে ইউক্রেনের পাল্টা হামলা ব্যর্থ করার ক্ষমতা অল্পই আছে। পরিবর্তে ক্রেমলিন এই সংঘাতের মোড় ঘুরিয়ে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় কাজে লাগাতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।

এ হামলার দায় কিয়েভের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আগের কতগুলো ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যেখানে একটি বোমা বিস্ফোরণের জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছিল ক্রেমলিন। ইউক্রেনের ল্যাবে জৈব রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষা চালানোর জন্য ওয়াশিংটনকে দায়ী করা হয়েছিল। নোভা কাখোভকা ড্যামের ধ্বংসকে তাই যুদ্ধের নতুন পর্ব হিসেবে দেখা যায়। মস্কো এর মাধ্যমে যুদ্ধ সম্পর্কিত বয়ান তার পক্ষে রাখতে চায়।

কিন্তু একটি বাঁধ, যা আমেরিকার গ্রেট সল্ট লেকের আকারের মতো পানির অংশকে আটকে রেখেছিল, যা ক্রিমিয়াকে জলবিদ্যুৎ শক্তি এবং সুপেয় পানি ও সেচ সরবরাহ করছিল; সেটি ধ্বংস হওয়া এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য একটি নির্মম অবহেলার ইঙ্গিত দেয়। আবার এর মধ্যে বেশিরভাগই জাতিগতভাবে রাশিয়ান।

ক্রেমলিনের এসব বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও বলা যায়, রাশিয়া ইউক্রেনকে তার বর্তমান নেতৃত্ব থেকে মুক্ত করতে যতটা আগ্রহী, তার চেয়েও বেশি আগ্রহী একটি সার্বভৌম জাতি হিসেবে ইউক্রেনের টিকে থাকার ক্ষমতা ধ্বংস করায়। জোরপূর্বক নির্বাসন, ১৯ হাজার শিশুকে অপহরণ এবং বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণ– সবই এমনতর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির লক্ষ্যেই করা হয়েছে। পদক্ষেপটি মূলত সেই পদ্ধতিরই অংশ, যা আগামীতে দেশটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ইউক্রেনের লোকজনের ওপর এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের সম্ভাব্য প্রভাব উল্টো দেশকে মুক্ত করার জন্য তাদের সংকল্পকে শক্তিশালী করতে পারে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে রাশিয়া যেন আর কোনো হামলা করতে না পারে, তার ব্যবস্থাও হতে পারে।

স্টিফেন উল্ফ ও ডেভিড হাস্টিংস ডান: বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; দ্য কনভারসেশন থেকে ভাষান্তর এহ্‌সান মাহমুদ