গত ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিজয়ীদের উষ্ণ অভিনন্দন, কলাকুশলীদের প্রশংসার পাশাপাশি চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান বিষয়েও কথা বলেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন, ‘মাত্র ২০ লাখ টাকায় একটা শর্ট ফিল্ম নির্মাণ হয় কীভাবে!’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীকে এই বরাদ্দ বাড়ানোর নির্দেশনা দেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে বিষয়টি নিজেই দেখবেন বলে কথা দেন। আমরা সব চলচ্চিত্র কর্মী এবং মিলনায়তনভর্তি দর্শক প্রধানমন্ত্রীর কথায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে হাততালি দিয়ে পরিবেশ মুখর করে তুলি।     

দুই.

চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে প্রামাণ্যচিত্রকে যুক্ত করা হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। তারপরও প্রামাণ্যচিত্রকে কাহিনিচিত্রের পাশাপাশি পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে বর্তমানে। সে জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু এই পুরস্কার প্রদানে একটি ‘ফাঁক’ রয়ে গেছে! প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদান করা হয় সাকল্যে একটি! সেটাও আবার প্রযোজককে। অর্থাৎ যিনি প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণে অর্থ লগ্নি করছেন। প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত কোনো সৃষ্টিশীল মানুষকে নয়! প্রযোজককে পুরস্কার অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য; কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত অন্যদের কেন নয়?

আমরা জানি– কাহিনিচিত্রে চিত্রনাট্য, পরিচালনা, চিত্র গ্রহণ, সম্পাদনা, শব্দ গ্রহণ, শব্দ সংযোজন, শিল্প নির্দেশনা, আলোক সম্পাত, আবহ সংগীতসহ অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। অথচ কাহিনিচিত্রের ক্ষেত্রে উল্লিখিত প্রতিটি বিষয় প্রামাণ্যচিত্রেও বিদ্যমান। শুধু অভিনয়, মেকআপ, কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংলাপ রচনা বাদে বাকি সব বিষয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণেও প্রয়োজন। উপরন্তু প্রামাণ্যচিত্রে বাড়তি প্রয়োজন হয় গবেষণা, রেকি, অধিবক্তার সঙ্গে কথনের প্রিলিউড এবং ক্ষেত্রবিশেষে ‘ঝুঁকি’ মোকাবিলা!

দীর্ঘ ৪১ বছরের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা থেকেই বিনীতভাবে বলছি, বর্তমান ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নীতিমালা’র সীমাবদ্ধতার কারণে প্রামাণ্যচিত্রের বিভিন্ন শাখায় যেসব সৃষ্টিশীল মানুষ অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকছেন। প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে নিদেন পক্ষে এই ক্ষেত্রগুলোতে জাতীয় পুরস্কার প্রদান চালু করা যেতে পারে– চিত্রনাট্য, পরিচালনা, চিত্র গ্রহণ, সম্পাদনা, শব্দ গ্রহণ ও আবহ সংগীতে।

তিন.

সৌভাগ্যবশত এবার আমিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০২১) অর্জন করেছি ‘বধ্যভূমিতে একদিন’ প্রামাণ্যচিত্রের জন্য। কিন্তু সেটা প্রামাণ্যচিত্রের ‘প্রযোজক’ হিসেবে; সৃষ্টিশীল নির্মাতা হিসেবে নয়! অথচ ‘নির্মাতা’ হিসেবেই প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য আমাকে পরিকল্পনা ও কল্পনা করতে হয়েছে বছরের পর বছর। আমার চাইতেও বেশি সৃষ্টিশীল মানুষের সমন্বয়ে গঠিত নির্মাণ দল নিয়ে নীলফামারী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১৪৮টি বধ্যভূমিতে কাজ করতে হয়েছে। ওসবের মূল্যায়ন কি আসলেই হয়েছে? ধরা যাক, পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রামাণ্যচিত্রটি অন্য কোনো ব্যক্তি ‘প্রযোজনা’ করেছেন। তাহলে এত শ্রম, মেধা আর সৃষ্টিশীলতায় যে পরিচালক প্রামাণ্যচিত্রটি সবার কাছে তুলে ধরলেন, তাঁর জন্য কী অবশিষ্ট থাকত! উল্লেখ্য, কাহিনিচিত্রে কিন্তু নির্মাতা এবং প্রযোজক– উভয়ের জন্য আলাদা পুরস্কারের ব্যবস্থা চালু আছে!

তবে এটা তো অতিশয় সত্য যে, রাষ্ট্রীয় সব পুরস্কারই অমূল্য! এর মর্যাদাই আলাদা! এই পুরস্কার অর্জন করে আমি অবশ্যই ধন্য ও সম্মানিত। এই সম্মান, এই স্মৃতি আমাকে আমৃত্যু উজ্জীবিত রাখবে, উদ্দীপ্ত করবে। কিন্তু সেটা যদি প্রযোজক হিসেবে না পেয়ে নির্মাতা হিসেবে পেতাম; এই স্বীকৃতি আরও সার্থক হতো।   

চার.

লক্ষণীয়, সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে বর্তমানে একেকটি ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র’ নির্মাণে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। কিন্তু ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র’ নির্মাণে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়; যদিও শুরু হয়েছিল মাত্র ২০ লাখ টাকা দিয়ে। ‘বধ্যভূমিতে একদিন’ নির্মাণেও ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। বৈষম্যটি অযৌক্তিক ও বেদনাদায়ক। আমার মতে, পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে অনুদানের সর্বোচ্চ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকা উচিত নয়। আরও দুঃখের বিষয়, বর্তমানে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রের জন্য অনুদান বন্ধ রাখা হয়েছে বলে শুনেছি। এই অবস্থার নিরসন হওয়া উচিত।   

কাহিনিচিত্রের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকার অঙ্কটিও কিন্তু যথেষ্ট নয়। কারণ অনেক সময়ে দেখা যায়, কাহিনিচিত্রের ক্যানভাস হয় বিশাল আকারের। আকার অনুযায়ী তাদের নির্মাণ ব্যয়ও বৃদ্ধি পায় আনুপাতিক হারে। বিশেষত ইতিহাসনির্ভর কোনো কাহিনিচিত্র নির্মাণে ‘ঐতিহাসিক পটভূমি’ পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে প্রাক্কলিত বাজেট ছাড়িয়ে প্রকৃত ব্যয় অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে একটি মানসম্পন্ন কাহিনিচিত্র নির্মাণে ‘প্রকৃত বাজেট’ সংগ্রহ করতে নির্মাতাদের হিমশিম খেতে হয়। অভীষ্ট অর্থ সংগ্রহের জন্য অনেক সময় মতাদর্শের বাইরে গিয়েও সহ-প্রযোজকের সঙ্গে হাত মেলাতে হয় নির্মাতাদের! এটা সত্যিই বেদনাদায়ক! এই ‘জিম্মিদশা’ থেকে কাহিনিচিত্রের নির্মাতাদের মুক্তিদানের জন্য বিনীত অনুরোধ জানাই। সে ক্ষেত্রে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রে অনুদানের বর্তমান অঙ্কটা সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকা নির্ধারণ করা গেলে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের পথ সুগম হবে।

পাঁচ.  

অত্যাধুনিক প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন অনেক আগেই। সেই অর্থ আজও ‘অনড়’ অবস্থায় পড়ে রয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে। (অলস পড়ে আছে সিনেমা হল তহবিলের হাজার কোটি টাকা, সমকাল, ২৯ মার্চ ২০২৩)। কেন আজ অব্দি কোনো উদ্যোক্তা এই বরাদ্দ থেকে অর্থ নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ বা মিলনায়তন বা সিনেমা কমপ্লেক্স নির্মাণে এগিয়ে আসছেন না; সেটা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ, চলচ্চিত্রের সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁদের সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব দিয়ে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। আর সেই ডিজিটাল প্রযুক্তির চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শিত হবে অ্যানালগ পদ্ধতির প্রেক্ষাগৃহে; দর্শক বঞ্চিত হবেন আধুনিক প্রজেকশন সিস্টেমের আনন্দ থেকে– সেটা যুক্তির কথা হতে পারে না! 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৫৭ সালে ‘ঢাকা চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এ দেশের চলচ্চিত্রকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুক্ত করেছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। মঞ্চ নাটককে মুক্ত করেছেন ঔপনিবেশিক ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ থেকে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বর্তমান চলচ্চিত্রকে আরও সুন্দর, নান্দনিক ও মানসম্পন্ন করতে সহৃদয় পৃষ্ঠপোষকতা দেবেন– এটাই প্রত্যাশা।

কাওসার চৌধুরী: প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা