- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- লোডশেডিংয়ে হ্যাঁ, নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে না?
জ্বালানি
লোডশেডিংয়ে হ্যাঁ, নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে না?

চরম জ্বালানি সংকট থেকে গত বছর জুলাইয়ে উদ্ভূত বিদ্যুতের ব্যাপক লোডশেডিং এ বছর মে-জুন মাসে এসে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ডিজেল আমদানিতে ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য দেশের ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। এলএনজিচালিত অনেক বিদ্যুৎ প্লান্টও বন্ধ থাকছে ডলার সংকটে এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেওয়ায়। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে কয়লার অভাবে রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎ প্লান্ট ঠিকমতো চালু রাখা যাচ্ছে না। প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি অর্জন সত্ত্বেও এই গ্রীষ্মকালের তীব্র গরমের দিনে দৈনিক উৎপাদন ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াটে সীমিত রাখতে হচ্ছে।
এই সংকটের জন্য প্রধানত দায়ী আমদানিকৃত এলএনজিনির্ভর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি। কেউ কেউ যে বলছেন, কয়েকজন প্রভাবশালী আমদানিকারককে অন্যায্য সুবিধা দেওয়ার জন্যই এই আমদানিকৃত এলএনজিনির্ভরতা; সেটা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এই নীতির কারণে দৃশ্যত একদিকে অবহেলার শিকার হয়েছে গ্যাস অনুসন্ধান; অন্যদিকে যথাযথ অগ্রাধিকার পায়নি সৌরবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি। ২০২০ সাল পর্যন্ত এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম সস্তা থাকায় হয়তো এই নীতি গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু এর ওপর অতিনির্ভরতা এখন চরম বিপদে ফেলেছে আমাদের।
২০২০ সাল থেকে এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম এমনিতেই কয়েক গুণ বেড়েছে। আবার ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর কারণেও এলএনজি ঘাটতি চরম আকার ধারণ করেছিল। অবশ্য দাম এখন খানিকটা কমে এসেছে। তেলের দামও ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২২ সালের মে মাসে ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল; এখন আবার কমছে। এ বছর মে মাস থেকে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৫-৮০ ডলারে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, দেশের স্থলভাগে গত ১৪ বছরে কয়েকটি ছোট ছোট গ্যাসকূপ ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেল-গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভোলা গ্যাসের ওপর ভাসছে– বলা হলেও ভোলার গ্যাস এলএনজি বা সিএনজিতে রূপান্তরিত করে দেশের মূল ভূখণ্ডে আনার কাজটি শুরু হয়নি!
২০১২ ও ’১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের বিরুদ্ধে মামলায় জিতে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও মামলায় জেতার পর ৯-১১ বছরে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হয়নি। সম্প্রতি মার্কিন তেল কোম্পানি এক্সন মবিল দেশের ১৫টি গভীর সমুদ্র ব্লকে অনুসন্ধানের ইজারা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ মিয়ানমার অতীতে তাদের নৌবাহিনী পাঠিয়ে কোরিয়ান কোম্পানি দাইউকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানে বাধা দিয়েছিল। যদিও প্রতিবেশী দেশটি আমাদের সেন্টমার্টিনের অদূরে তাদের সমুদ্রসীমা থেকে পাঁচ টিসিএফের বেশি গ্যাস আহরণ করে চলেছে। মার্কিন কোম্পানির বিরুদ্ধে মিয়ানমার ওই ধরনের জবরদস্তির সাহস পাবে না।
যা হোক, নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্রতি অবহেলা মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশে হয়তো বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ কম; কিন্তু সৌরবিদ্যুৎকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না কেন? ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংরেজি জাতীয় দৈনিক দি ডেইলি স্টারে একটি কৌতূহলোদ্দীপক নিবন্ধ পড়েছিলাম। ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস সংস্থার জ্বালানি অর্থায়ন বিষয়ক বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস একটি বিস্ময়কর তথ্য তুলে ধরেছিলেন। তা হচ্ছে, মাত্র সেদিন, ২০২০ সালে, ভিয়েতনাম বাড়ির ছাদের সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছিল। গত তিন বছরে তাদের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন আরও কয়েক হাজার মেগাওয়াট বেড়েছে নিশ্চয়। অথচ ২০২০ সালে বাংলাদেশের সোলার পাওয়ার উৎপাদন ছিল ৩০০ মেগাওয়াটেরও কম। আর ২০২২ সালে এসে মাত্র ৯৬৬ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদনের মাত্র ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। ওদিকে ২০২২ সালেই চীন তাদের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ১১ লাখ মেগাওয়াটের ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করেছে। ২০২২ সালে ভারত বিদ্যুৎ চাহিদার ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ পেয়েছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে।
স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশের ‘সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’-স্রেডা তাদের ঘোষিত জাতীয় সৌরবিদ্যুৎ রোডম্যাপে ৩০ হাজার মেগাওয়াটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ১২ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ ছাদভিত্তিক সোলার প্যানেল থেকে আহরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু রোডম্যাপ ঘোষণার পর কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণের উপযুক্ত কর্মসূচি আজও গৃহীত হলো না কেন?
দেশের বিদ্যুৎ খাতের জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে চীন, ভারত ও ভিয়েতনামের সোলার পাওয়ারের সাফল্যের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিটি অবিলম্বে ঢেলে সাজাতে হবে। অনেকেই হিসাব করে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রাক্কলিত সৌরবিদ্যুতের ১২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে ৫ হাজার মেগাওয়াট শুধু পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলোর ছাদ ব্যবহার থেকেই পাওয়া যেতে পারে। সরকারি বিভিন্ন ভবনের ছাদ ব্যবহারের মাধ্যমে আরও ২ হাজার মেগাওয়াট পাওয়া যাবে। বড় বড় নগর ও মফস্বল শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ির ছাদ ব্যবহারের মাধ্যমে বাকি ৫ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন মোটেও অসম্ভব মনে হচ্ছে না। শুধু প্রয়োজন হবে সোলার প্যানেল ও ব্যাটারির ভর্তুকি দাম কর্মসূচি বাস্তবায়ন; সৌরবিদ্যুতের যন্ত্রপাতির ওপর আরোপিত শুল্ক হ্রাস এবং যুগোপযোগী ‘নেট মিটারিং’ পদ্ধতি চালু করা।
কথা হচ্ছে, দেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ২০২২ সালেও এক হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাতে পারেনি কেন– তা জরুরিভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন। গণচীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত, ফিলিপাইন এবং জার্মানি ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে। সোলার প্যানেল ও ‘ব্যাটারি’র দামে সুনির্দিষ্ট ভর্তুকি প্রদান এবং ভর্তুকি দামে ‘নেট মিটারিং’ স্থাপনে প্রণোদনা প্রদান এসব দেশের সাফল্য অর্জনের প্রধান উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
রূপপুর পরমাণু শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করার জন্য আমরা ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করছি, যেখান থেকে ২০২৪ সাল নাগাদ আমরা নাকি ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাব। ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মোট ব্যয়ের অর্ধেকও হতো না। অথচ সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব এবং ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তি। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যে গণচীন, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে।
সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে খালি জায়গা অনেক লাগে বিধায় বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে তা উৎপাদন সম্ভব নয় বলে যে ধারণা রয়েছে, তাও ঠিক নয়। দেশের সমুদ্র উপকূল, নদী ও খালগুলোর দু’পাড়ে সোলার প্যানেল স্থাপনের সম্ভাবনাটি খতিয়ে দেখা হোক। সম্প্রতি জার্মানি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে বাংলাদেশকে বিপুলভাবে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জমির তুলনামূলক স্বল্পতার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যাবে, যদি দেশের বিশাল সমুদ্র উপকূলে একই সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রধান অগ্রাধিকার প্রদান করুন। ২০২১ সালে দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার ঐতিহাসিক সাফল্যকে টেকসই করার জন্য নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকে বিদ্যুতের প্রধান উৎসে পরিণত করা সময়ের দাবি।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
মন্তব্য করুন