সিরাজুল আলম খান, আমাদের সিরাজ ভাই লোকান্তরিত হলেন। আমাদের অনেকেই আবার তাঁকে ‘দাদা ভাই’ বলে ডাকতেন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ তৈরি হয় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়ে। আমার মতো আরও অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তাঁর মাধ্যমে।

সিরাজুল আলম খান দেশের যুবসমাজকে স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে এবং কথা হলেও স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত হওয়া যেত। ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি এই দেশের যুবসমাজকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে রেখেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই এ অঞ্চলের যুবসমাজ স্বাধীনতার জন্য একত্রিত হওয়ার মন্ত্র পেয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য এখানে যে জাতীয় নিউক্লিয়াস গঠন করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।

১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সিরাজুল আলম খান। ছয় ভাই তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সিরাজুল আলম খান ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন ১৯৫৬ সালে। ওই বছরেই ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং এর পর তিনি আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। তখনকার ছাত্রলীগ নেতাদের সাহচর্যে এসে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি খুব সহজেই তৎকালীন সেরা সরকারি চাকরিতে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। কিন্তু সে পথে না হেঁটে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন দেশমাতৃকার সেবায়।

সে সময় ডান-বাম মিলিয়ে উদীয়মান ছাত্রনেতার অভাব ছিল না। কিন্তু পরিশ্রম করার তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ধীশক্তির কারণে সিরাজুল আলম খান ষাটের দশকের শুরুতেই তখনকার তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিতে পড়েন। শেখ মুজিব তাঁকে কাছে টেনে নেন। শুরু হয় দু’জনের ঘনিষ্ঠ পথ চলা

আমাদের রাজনীতিতে সবসময়ই একটা আপসকামী ধারা এবং একটি স্বাধীনতাকামী ধারা ছিল। আওয়ামী লীগেও এ বিভাজন ছিল এবং এর অনিবার্য প্রতিফলন ছাত্রলীগেও ছিল। আপসকামী ধারার রাজনীতিকরা বরাবরই পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলমিশ করে থাকতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বড়জোর স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। ছাত্রলীগের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এ ধারার সঙ্গে স্বাধীনতাকামীদের বিরোধ লেগেই ছিল। এ স্বাধীনতাকামীদের নেতা হিসেবে সিরাজুল আলম খান সবসময়ই রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম বা আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের একটি ধারা দিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামীরা শুধু স্বাধীনতাই নয়, এমনকি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখেছিল।

সিরাজুল আলম খান বরাবর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই সমস্ত কাজ করেছেন। তাঁর সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধুই ছিলেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধু এবং সিরাজুল আলম খানকে সমান্তরাল নেতৃত্ব হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি কখনোই নিজেকে তেমনটা মনে করতেন না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে নেতা মেনেই কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন বঙ্গবন্ধু হননি; যখন তিনি শেখ মুজিব হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সেই সময়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবের শব্দটি তিনিই বাছাই করেছিলেন। সিরাজ ভাই শেখ মুজিবকে ডাকতেন ‘মুজিব ভাই’ বলে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তবে আমি মনে করি, তিনি এটা পারতেন না যদি সিরাজুল আলম খান এবং নিউক্লিয়াস নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ তাঁকে সর্বাত্মক সমর্থন-সহযোগিতা না করত।

পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদকে নিয়ে গঠন করেন ‘নিউক্লিয়াস’। এই নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বেই ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফাসহ যাবতীয় আন্দোলন হয়।

সিরাজুল আলম খানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নতুন সংগঠন শ্রমিক লীগ, বিএলএফ, জয় বাংলা বাহিনী এবং মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্ধারণ, জয় বাংলা স্লোগান, বঙ্গবন্ধু উপাধি, ২ মার্চ আ স ম আব্দুর রব কর্তৃক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ শাজাহান সিরাজ কর্তৃক স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ ছাড়াও অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার নায়ক ও রূপকার ছিল নিউক্লিয়াস এবং অবশ্যই সিরাজুল আলম খান। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন তাঁরা।

এ নিউক্লিয়াস কতজনকে যে নেতা বানিয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। এসব ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা ছিল সিরাজুল আম খানের। ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছাড়ার পর পুরোটা সময় তিনি মঞ্চের চেয়েও ছিলেন মাঠের নেতা।

১৯৬২-১৯৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে এই ‘নিউক্লিয়াস’। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গড়ে তোলা হয় ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং বিএলএফ এবং সামরিক ইউনিট ‘জয় বাংলা বাহিনী’। এমনকি ৭ মার্চ শেখ মুজিবের ভাষণ কেউ কেউ মনে করেন, সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে দেওয়া হয়েছিল।

ষাটের দশকে তিনি ৬ দফা দাবির সমর্থনে জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। বলতে গেলে এ সময়েই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে নিবিড় হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর নানা কারণে মতভেদ তৈরি হয়। একটা পর্যায়ে তিনি ছাত্রলীগ থেকে সরে যান। নতুন ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর উদ্যোগ, চিন্তা ও তৎপরতায় গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী সভা স্থগিত ঘোষণার পরপরই ২ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত নির্ধারণসহ ৩ মার্চ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ ঘোষণার পরিকল্পনাও ছিল নিউক্লিয়াস তথা সিরাজ ভাইয়ের। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই দুটি কাজ ছিল প্রথম দিকনির্দেশনা।

সিরাজুল আলম খানের যে অবদানটির কথা আমি সবশেষে উল্লেখ করতে চাই, এটিই সম্ভবত তাঁর শ্রেষ্ঠ ভূমিকা। সেটি হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে তিনি এই দেশের শ্রমিক এবং যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ছাত্র-যুবক-শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর চেষ্টা ও সামর্থ্য প্রায় অদ্বিতীয়। আমাদের নতুন প্রজন্ম সিরাজ ভাই সম্পর্কে জানবে এবং তা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আগামী দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে– এটাই আজকের এ বেদনাবিধুর দিনে আমার প্রত্যাশা।

শরীফ নুরুল আম্বিয়া: বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি