- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- মার্কিন দাগ থেকেই যদি দারুণ কিছু হয়...
রাজনীতি
মার্কিন দাগ থেকেই যদি দারুণ কিছু হয়...

বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য-বিবৃতি, বিশেষ করে নতুন ভিসা নীতিকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক এবং সুশীল মহল স্পষ্টতই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক দল খোলাখুলিভাবে মার্কিন ভূমিকাকে স্বাগত জানাচ্ছে। অন্য দল এর বিরোধিতায় মুখর। যারা মার্কিন ভূমিকার বিরোধিতা করছে, তারা কখনও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মার্কিন ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসে, কখনও আবার আফগানিস্তান-ইরাকের উদাহরণ টেনে তার গুষ্টি উদ্ধার শুরু করে ছেড়েছে। গলির মোড়ের চায়ের দোকান থেকে টিভি চ্যানেলের টকশো– সর্বত্রই এক অবস্থা। বিষয়টি দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণের দাবি রাখে বলে মনে করি।
অস্বীকার করার উপায় নেই, ১৯৭১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এক ন্যক্কারজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে তারপর পাঁচ-পাঁচটি দশক চলে গেছে। এ সময়ে দুই দেশের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্কও পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। এক সময় আমাদের দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে যেত তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে। আজ আর কেউ ওদিকে যায় না। সবারই লক্ষ্য আমেরিকা, বিশেষ করে নর্থ আমেরিকা। কারণ, আজ বাংলাদেশের চাকরির বাজারে মার্কিন মুলুকের সনদের দাম অনেক বেশি।
ইতোমধ্যে বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। দেশে দেশে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন বদলে দিয়েছে চিরাচরিত উৎপাদন ব্যবস্থা আর উৎপাদন সম্পর্ক। স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন আসছে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায়। কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা ক্রমে প্রসার লাভ করছে। সে কারণেই আজকের পৃথিবীতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় মানবাধিকার, সুশাসন, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা– এসব বিষয় বেশি করে প্রাধান্য পাচ্ছে। এই বাস্তবতায় আজ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে, তখন একে বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেচনা করতে হবে। ৫০ বছর আগের বাস্তবতায় বিচার করলে ভুল হবে। পাশাপাশি এ-ও মনে রাখতে হবে– ১৯৭১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনও পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অস্ত্র জোগান দেওয়াসহ সম্ভাব্য সব রকম সহযোগিতা করেছিল। আবার এটাও ঠিক, ওই সময়ের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাই আমেরিকা ও চীনকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছিল।
তবে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বর্তমানে বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রধান মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে যা করে, তা তার নিজের তথা পুঁজিবাদের স্বার্থেই করে। আফগানিস্তানে আমেরিকা যা করেছে, তাও পুঁজিবাদের সাধারণ সূত্র মেনে করেছে। এ কথা সবাই জানে, গত শতাব্দীর শেষদিকে বিশ্ব যখন শীতল স্নায়ুযুদ্ধের অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখনই আফগানিস্তানে মার্কিন প্রবেশ। একদিকে বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিকতার শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ঢেউ, অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা পুঁজিবাদী বিশ্বকে ভীত করে তুলেছিল। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তানে তার বলয় প্রসারিত করে, আমেরিকা তা মেনে নিতে পারেনি। সেও আফগানিস্তানে ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করে। এভাবেই আফগানিস্তান হয়ে ওঠে দুই পরাশক্তির আধুনিক কুরুক্ষেত্র। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আজ যাঁরা আফগানিস্তানে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছেন, তাঁরাও কিন্তু শুরুতে ওখানে মার্কিন ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কারণ তখন ওখানে দ্বন্দ্বটা ছিল সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদের। যেই না সোভিয়েত ভেঙে গেল, অমনি সমর্থনের দৃশ্যপট পাল্টে গেল। পরিবর্তিত অবস্থায় অনেকে এ কথাও ভুলে গেলেন, যে তালেবানকে ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছিল, সেই তালেবানই সময়ের পথপরিক্রমায় হয়ে গেল চীনের বন্ধু।
আসলে ইতিহাস জিনিসটাই এমন। ব্রিটিশরা প্রায় ২০০ বছর এই উপমহাদেশ শাসন করেছিল। এই ২০০ বছরে এ দেশে স্বাধীনতার দাবিকে দাবিয়ে রাখার জন্য খুনখারাবিও কম করেনি। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে। সব শেষে বিদায়ের সময় দেশটাকে টুকরো করে গেছে। সেই ব্রিটিশের সঙ্গে আজ আমাদের হৃদয়তার কমতি নেই। এরই নাম রাজনীতি। এভাবেই সময়ের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির ধারা যেমন বদলে যায়, তেমনি বদলে যায় বৈশ্বিক রাজনীতির চেহারাও।
আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, মানুষ নিজের মতো করে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না; কথা বলতে পারে না। সভা-সমাবেশ করার মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারটুকুও লাল ফিতায় বন্দি। ২০১৮-এর সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষকে এক দুঃস্বপ্নের মতো নিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। নির্বাচন নিয়ে তারা দেশের কাউকেই আর বিশ্বাস করতে চায় না। এমনই একটা অবস্থায় কোনো দেশ এখানে কূটনৈতিক প্রভাব খাটাতে চাইলে, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে– খুব বেশি মানুষের এমনটা মনে করার কথা নয়।
তবে অনেকেই আছেন, যাঁরা এটাকে দেশের জন্য সম্মান হানিকর মনে করছেন। তাঁদের আবেগের প্রতি সম্মান রেখেই বলব– যতই সম্মান হানিকর হোক না কেন, আমরা নিজেরাই এ অবস্থার জন্য দায়ী। আমরা আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে বারবার বিদেশিদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ করে দিয়েছি। এটা যে কেবল আমেরিকার ক্ষেত্রে হচ্ছে, এমন নয়। অনেক দেশই আমাদের রাষ্ট্রীয় বিষয়ে নাক গলিয়েছে এবং গলাচ্ছে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তাঁর আত্মজীবনীতে এমন অনেক ঘটনার কথা লিখে গেছেন, যেখানে স্বীকার করে গেছেন কেমন করে তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন।
এ কথা স্বীকার করতে হবে, যতদিন আমরা নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধানের কোনো সম্মানজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি না করতে পারব, ততদিন বাইরের শক্তি নাক গলাতে থাকবে। তবে সেই নাক গলানো থেকে যদি মঙ্গলজনক কিছু বেরিয়ে আসে, তাকে মেনে নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ওই যে একটা বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম– দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে দাগই ভালো। আপাতত না হয় সে আশাতেই থাকি!
মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন