- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- অর্থনৈতিক সংকট শিগগিরই কাটছে না
সমকালীন প্রসঙ্গ
অর্থনৈতিক সংকট শিগগিরই কাটছে না

সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর শনাক্তকরণ নম্বর টিআইএনধারী সবার ওপর ন্যূনতম দু’হাজার টাকা আয়কর নির্ধারণ করেছে এবং তা নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। তবে এ বিষয়টি আমার কাছে ‘ওয়ান টাইম’ জিনিস ব্যবহারের মতো। ঘোষণাটা শুনতে যেমনই শোনাক, অনেককেই বাস্তবে এ কর একবার দিতে হবে। ধরা যাক, একজনকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। আগে টিআইএন নম্বর জমা দিলেই হতো। এখন সেটার জন্য দুই হাজার টাকা খরচ হবে। অর্থাৎ আগে যেটা টিআইএন নম্বরের জন্য শূন্য কর হতো, এখন সেটার জন্য দুই হাজার টাকা দিতে হবে। এটা আমার কাছে খুব বড় বিষয় নয়। কেবল এটার দিকে নজর দেওয়ায় বাজেটের অন্যান্য দিক আড়ালে চলে যাচ্ছে বলেও আমি মনে করি। এ দু’হাজার টাকার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, অন্যান্য করের হার আমাদের এখানে অনেক বেশি, যা নিয়ে আলোচনা খুব কমই।
বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ৬০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত কর আদায়ের কথা বলা হচ্ছে। এখন আমাদের অর্থনীতি খারাপ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি অর্থনীতি খারাপ হয়, তাহলে তো কর কম আসার কথা। বাড়তি ওই রাজস্ব আসবে কোথা থেকে? কিছুদিন আগে আমরা আইএমএফের ঋণ পেয়েছি। আইএমএফের শর্ত ছিল– রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। সে শর্ত পূরণের অঙ্গীকার থেকেই যে গত বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা বুঝতে কারও বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। তবে আমার কাছে মনে হয়, এটা খুবই কঠিন হবে। দেশের সার্বিক অর্থনীতি যদি ঊর্ধ্বমুখী হতো তাহলে হয়তো এটা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি ভিন্ন।
প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির যে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে, সেটিও অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। হবে না বললেই চলে। দেশে বাজেট পূরণে অতিরিক্ত যে করের বোঝা দেখা দিয়েছে, সেটি কে বহন করবে– এই প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।
সম্প্রতি আমরা করোনা মহামারির মতো একটি বড় ধরনের দুর্যোগ থেকে বের হয়েছি। সেই সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে। এই সময়ে বাড়তি করের বোঝা কোন দিকে যাবে, তা আগে ভেবে দেখা দরকার ছিল। ধীরে ধীরে লোকজনের আর্থিক অবস্থা নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। মানুষজন একটি গর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের লোকের অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ এবং অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়লে বাড়তি কর আদায় করা যেত। তখন কর আদায় করাও সহজ হয়। এখন বিনিয়োগ কম, আবার দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এমনকি মধ্যবিত্তদেরও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় অতিরিক্ত কর আদায় কঠিন হয়ে যাবে। এই সময়ে মূল্য সংযোজন কর তেমন আদায় হওয়ার কথা নয়। কারণ ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে ধীরগতি সবাই দেখতে পাচ্ছে। আমদানি হলো মূল্য সংযোজন কর আদায়ের সবচেয়ে বড় উৎস। আর খুব শিগগিরই এ সংকট কাটবে বলে মনে হয় না।
আমাদের করপোরেট আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর একটি অপরটির সঙ্গে যুক্ত। কতটা আদায় করা যাবে, তার ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু। আর কখন ট্যাক্স আদায় করা যাবে? যখন আয় বেশি করা যাবে, তখন করপোরেট ট্যাক্স আদায় বেশি করা যাবে। অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব বজায় না থাকলে এটা করা সম্ভব নয়। আবার ব্যক্তিগত আয়করের হিসাবের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। যখন মানুষের আয় বেশি হয়, তখন ব্যক্তিগত কর আদায় ভালো হয়। অর্থনীতির গতি নিম্নমুখী হলে, অর্থনৈতিক লেনদেন কম হলে তো তা সার্বিক ট্যাক্স আদায়ের ওপরেই প্রভাব রাখবে। দেশের এখন যে পরিস্থিতি, আমার আশঙ্কা যথেষ্ট– এই পরিমাণ কর শেষ পর্যন্ত আদায় করা সম্ভব হবে কিনা।
এই বাজেট অবশ্যই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। পরিস্থিতি অনুসারে এটা আকারে বৃহৎ। যখন কোনো দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ ভাব চলে, তখন যে ধরনের বাজেট দেওয়া হয়, এটি সে ধরনের বাজেট। বর্তমানে যে বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার কোনো চিহ্ন এই বাজেটের দিকে তাকালে বোঝা যায় না। এই নাজুক পরিস্থিতিতে বাজেট যেমন হওয়ার কথা, এটা তেমন বাজেট নয়।
সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা নির্ভর করে সে দেশের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর। আমাদের জাতীয় জীবনে এখন একটি ভালো নির্বাচন যদি হয়, সেখানে যদি একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়, যাঁদের জবাবদিহি থাকবে; তাহলে তা সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। অনেক কিছুতে সাহস তৈরি হবে। এখন অর্থনীতিতে যে ভাটার টান চলছে, তার মধ্যে যদি আবার আগামী নির্বাচনটি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, একটি ভালো নির্বাচন না হয়; তাহলে দেশবাসীর ভোগান্তি বাড়বে। একটি ভালো নির্বাচন হলে দেশটা সম্পর্কে বিদেশিদের আগ্রহ তৈরি হয়। তারা সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। সামগ্রিকভাবে তা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করে। আর যদি সেটি না হয়, তাহলে বিদেশিরা দেশটির প্রতি আগ্রহ দেখায় না। আবার স্থানীয় উদ্যোক্তারাও ভয় পায়। তারাও বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবে না। তখন আমাদের যে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, তা আর অর্জিত হবে না।
চলতি বছরের জুন, জুলাই, আগস্টে দেশের রপ্তানি কেমন হবে, তার দিকে খেয়াল রাখলে অনেক কিছু বোঝা যাবে। এখন লোডশেডিং হচ্ছে। গৃহস্থালি কাজের মতো শিল্পকারখানায়ও এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব তো রপ্তানিতে পড়বে। এটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব রাখবে। আবার ডলার সংকটে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি গত বছরের তুলনায় অনেকটা কমে গেছে। অর্থনীতিতে যদি ক্যাপাসিটি বিল্ডআপ না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক গ্রোথ কোথা থেকে আসবে? এটা যে আকাশ থেকে আসবে না– আমাদের তা বুঝতে হবে।
অধ্যাপক আবু আহমেদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক
মন্তব্য করুন