এই মুহূর্তে বিশ্ব একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট দেখছে। দুটি বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি– যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি জাপানের হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জি-সেভেন গ্রুপের ৪৯তম শীর্ষ বৈঠক। জাপানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক তাৎপর্য বহন করে বিশ্বব্যবস্থার জন্যও। শিল্পোন্নত সাতটি দেশ, যারা বিশ্ব অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, এই গ্রুপের সদস্য। তবে দুই দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর গ্রুপটির প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।

জি-সেভেন সম্মেলনের পর ৬৬ দফাসংবলিত বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে আলাদা ঘোষণা এবং ইউক্রেন পরিস্থিতির ওপর শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক বিবৃতি প্রদান করা হয়। এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ গ্লোবাল সাউথের কয়েকটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। একই সঙ্গে আইইএ, আইএমএফ, ওইসিডি, বিশ্বব্যাংক ও ডব্লিউটিওর প্রধানরা সম্মেলনে যোগদান করেন। বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, বহুপক্ষীয় উন্নয়ন, আফ্রিকার সঙ্গে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, অভিবাসন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক বিষয় সম্মেলনের আলোচনায় উঠে এসেছে। সর্বজনীন মানবাধিকার, লিঙ্গবৈষম্য, মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে সম্মেলনে। স্ববিরোধী মনে হলেও এই বৈঠকে এমন এক বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করার কথা বলা হয়েছে, যেখানে আইনের শাসন থাকবে, থাকবে জাতিসংঘের সনদের প্রতিফলন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বহুপক্ষবাদ অনুসরণ করার কথাও বলা হয়েছে এবং যথারীতি রাশিয়াকে আরেক দফা নিন্দা জানানো হয়েছে।

আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে জি-সেভেন শীর্ষ বৈঠকটি বিশ্ব রাজনীতির জন্য নতুন বার্তা দিয়েছে। বলেছে, ভূরাজনীতিই মুখ্য বিষয়। বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব বাস্তবতা রুখে দিয়ে গ্রুপভুক্ত সাত শিল্পোন্নত দেশের আধিপত্য ধরে রাখার প্রয়াসই দেখা গেছে খোলাখুলিভাবে।

জি-সেভেন সম্মেলনে এটা স্পষ্ট– বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার উত্থান রোধ করতে চীন, রাশিয়া বা ভারতের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর উত্থানে লাগাম টেনে ধরতে চায় শিল্পোন্নত দেশগুলো। কারণ এই গ্রুপভুক্ত দেশগুলোর ব্যাপক আধিপত্য দৃশ্যত হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষত ২০০০ সালের পর থেকে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির তালিকা করলে দেখা যাবে যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি। অন্যদিকে পশ্চিমের অর্থনীতিগুলো ধারাবাহিকভাবে নিম্নগামী। এই বাস্তবতায় জি-সেভেনভুক্ত অর্থনীতিগুলোর জন্য অবস্থান ধরে রাখার বিষয় ছিল এই শীর্ষ সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। সেক্ষেত্রে তারা গ্লোবাল সাউথকে আরও কাছে টানার চেষ্টা চালাচ্ছে।

এই শীর্ষ সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য শক্তিশালী করা। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় ট্রান্স আটলান্টিক সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিল, ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সফলকাম হয়নি। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে সেই মতপার্থক্য দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।  চীনের ক্রমাগত উত্থান মাথায় রেখে পশ্চিম দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐক্য সৃষ্টি করতে পেরেছেনও তিনি। 

বৈশ্বিক যে বিষয়গুলোতে চীনের এক ধরনের আধিপত্য রয়েছে, সেই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে নজর দিয়েছে জি-সেভেন। যেমন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর একটি হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন। চীন এ ক্ষেত্রে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজ ও পরিকল্পনা করে যাচ্ছে দেশটি।

বস্তুত পশ্চিমা বিশ্ব বুঝতে পেরেছে, শুধু কথায় আর কাজ হবে না। শুধু কূটনৈতিক বক্তব্য আর ফল বয়ে আনতে পারবে না। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে সাহায্য করতে হবে। এমনকি ইউরোপের অনেক দেশের যে বেহাল অবকাঠামো, সেটিকে নজরে আনা হয়েছে সম্মেলনে। 

সার্বিক বিচারে জি-সেভেন মূলত চীন ও রাশিয়াকে মাথায় রেখে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। নিরস্ত্রীকরণ ও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধের যে কথা বলা হয়েছে, তা মূলত রাশিয়া ও চীনের দিকেই ইঙ্গিত করে। কেননা, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের যে ধরনের সামরিক ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে চুক্তি ছিল তা অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। স্টার্টসহ অন্যান্য চুক্তি থেকে যখন যুক্তরাষ্ট্র অথবা রাশিয়া বেরিয়ে আসে তখন নতুন করে অস্ত্র উৎপাদনের এক সম্ভাবনা তৈরি হয়। অন্যদিকে বিশ্বের এক নতুন অস্ত্র বাজার তৈরি হয়েছে। সেখানেও অস্ত্রের এক বড় ধরনের বাণিজ্য শুরু হতে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সব থেকে বেশি অস্ত্রের উৎপাদন দেখেছে বিশ্ব।

নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় দেখা যেতে পারে স্নায়ুযুদ্ধ ভিন্নরূপে ফিরে আসছে। নতুন করে শুরু হতে পারে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন দেশের মধ্যে তীব্রতর হতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রভাব বাড়তে পারে মেরূকরণের। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে মার্কিন, ভারত বা চীনপন্থি নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। এতে করে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরও দ্বিধাবিভক্ত হবে।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই দ্বিধাবিভক্তি অবশ্য বৈশ্বিক শক্তিগুলোর এক কৌশলেরই অংশ। অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলো দুর্বল করার মাধ্যমে তারা সেই দেশগুলোর অভ্যন্তরে শক্তিশালী অবস্থান তৈরির চেষ্টা করে। সঙ্গে সেই দেশগুলো বিভিন্ন বৈশ্বিক ইস্যুতে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতেও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে দেখা গিয়েছিল, কীভাবে বিভিন্ন বিষয়ে রাজনীতি ও সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে, সংস্কৃতি হয়ে পড়ে ভিন্ন ধারার অনুসারী।

বৈশ্বিক দক্ষিণের বা গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর উচিত, জি-সেভেন সম্মেলনে আলোচিত বিষয়গুলো আমলে নেওয়া। আরও বেশি মনোযোগী হওয়া। চীন, ভারত, ব্রাজিল বা রাশিয়ার মতো দেশগুলোর উত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে নতুন প্রভাবশালী সংগঠন, যেমন– ব্রিকস। বোঝাই যাচ্ছে এক গতিশীল ও পরিবর্তনশীল সময় আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। পরিবর্তন ঘটছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির। এগুলো মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এর জন্য প্রয়োজন আরও চিন্তা, আরও গবেষণার।

ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত