- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বিকল্পহীন নেতৃত্বের সামনে প্রশ্নচিহ্ন
উচ্চারণের বিপরীতে
বিকল্পহীন নেতৃত্বের সামনে প্রশ্নচিহ্ন

দাম্পত্য কলহে জর্জরিত স্বামী ও স্ত্রীকে প্রায়ই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শুনি– তার কারণেই সংসারটি টিকে আছে! অন্য কারও পক্ষে এই সংসার করা অসম্ভবসাধ্য ছিল! অভিযোগকারীর বক্তব্য এমন যে, তার অবস্থান বিকল্পহীন, তার জন্যই জগৎসংসার ঘূর্ণায়মান।
আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবস্থাও অনেকটা এ রকম– ‘বিকল্পহীন’। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিএনপির প্রধান নেতা খালেদা জিয়া মাঠে অনুপস্থিত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। সরকারের নির্বাহী আদেশে বর্তমানে তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করলেও প্রকৃতপক্ষে সাড়ে পাঁচ বছর ধরে খালেদা জিয়া কারাগারেই আছেন। তাঁর অবর্তমানে দলের প্রধান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান– দেড় দশক ধরে বিদেশে অবস্থানরত, আসছে সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর দেশত্যাগের ১৫ বছর পূর্ণ হবে।
গত দুই জাতীয় নির্বাচন– ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যুক্তিসংগত কারণেই বিভিন্ন আপত্তি আছে, নানা কায়দায় ‘একদলীয়’ নির্বাচনের এন্তেজাম হয়েছে বলে দেশে-বিদেশে বহু অভিযোগ উচ্চারিত হলেও বিএনপি ও সমমনারা একদলীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধের ব্যূহ তৈরি করতে ব্যর্থ। ২০১৪ সালে খালেদা জিয়া মাঠে ছিলেন, সেবারের হিসাব আলোচনার বাইরে রেখে অন্তরীণ খালেদা জিয়ার সময়ের বিএনপি নেতৃত্বের কথা আলোচনায় আনা যাক। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে তারেক রহমানের কিছু ভিডিও বক্তৃতা কোনোভাবেই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট ছিল না। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী সংসদ সদস্য, দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সংসদে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের পেছনে আদৌ কী যুক্তি ছিল, তা আজও বোধগম্য নয়। সংসদে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপির বিজয়ী সব সদস্যই তা করবেন, একা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কেন সংসদের বাইরেই থাকতে হলো, এতে বিএনপির কী লাভ হলো, কেউ জানে না।
অবশ্য দুষ্ট লোক অনেকে বলেছেন, জাতীয় সংসদে বিএনপির প্রধান নেতা হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতৃত্ব দিলে তিনি জাতির সামনে তাঁর মেধা ও দক্ষতার প্রকাশ ঘটিয়ে ফেলবেন, এতে লণ্ডনীয় ‘হাইকমান্ড’-এর প্রতি বিএনপি সমর্থকদের অন্ধ আনুগত্য কমে যেতে পারে! এ কারণেই মির্জা ফখরুলকে সংসদ সদস্য হবার পরও শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয় ‘হাইকমান্ড’। বিকল্পহীন নেতৃত্বের সামনে প্রশ্নচিহ্নের মতো উদয় হবে পারিবারিক বলয়ের বাইরের কোনো নেতা? কদাচ না। নৈব নৈবচ!
০২.
‘বিকল্পহীন নেতৃত্ব’ বিষয়ে দুষ্ট লোকেরা অবশ্য আরও কিছু বিশ্লেষণ হাজির করে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা বা গ্রেপ্তারের পর নজরকাড়া আদৌ কোনো আন্দোলন কি গড়তে পেরেছিল বিএনপি? কেন পারেনি? কারণ, সেরকম প্রতিবাদী নেতৃত্বই এই দলে বিকশিত হয়নি, মঞ্চ থেকে মঞ্চে একখানা চেয়ার খালি রেখে বক্তৃতা দেওয়ার মধ্যেই ছিল খালেদা জিয়ার জন্য বিএনপি নেতৃত্বের তৎপরতা। আজকাল অবশ্য দুইখানা খালি চেয়ার রাখা হয়, অপর খালি চেয়ারটি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য। এসবই অন্তঃসারশূন্য নেতৃত্বের ব্যর্থতা। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে ফোনে, ভিডিওতে এর-ওর কথা শুনে এত বড় একটা রাজনৈতিক দল পরিচালনার চেষ্টা আসলে কোন ধরনের মানসিকতা? নিজের রাজত্ব অন্য কাউকে ছেড়ে না দেওয়ার একরোখা চেষ্টা? শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে রাজনৈতিক দল মানে যার যার রাজত্ব! রাজনীতি করলে জেলে যেতে হয়– হবে; দমন-পীড়নের শিকার হতে হবে; তা না করে মুচলেকা দিয়ে দেশের সীমানা পার হয়ে দূরদেশে নিরিবিলি ভিডিওতে বসে বিদ্রোহ-বিপ্লবের ডাক দিয়ে অর্জনের ডালায় আদৌ কি যুক্ত হয়, তা ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা দেখেছি। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষেও আমরা শুনতে পাই বিএনপির লন্ডনমুখী বহুবিধ তৎপরতার
কথা। জানতে পাই, লন্ডনে বসে ঠিক হচ্ছে বাংলাদেশের ভাগ্য বদলের রূপরেখা!
ডিমের হালি ১৭০ টাকা, টমেটোর দাম কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা; হ্যাঁ, এই ঢাকা শহরে নিজে বাজার করতে যেয়ে রোজ সকালে কি রাতে যারা পর্যুদস্ত হয়ে ঘরে ফিরছেন, তাদের নিঃশব্দ ক্রন্দন আর একান্ত আর্তনাদ পৌঁছে না কোথাও। ক’দিন পরপর কাগজে খবর বেরোয়– বাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজি! আজ কাঁচামরিচের দাম ৫০০ টাকা, কাল সয়াবিন তেল ধরাছোঁয়ার বাইরে, পরশু চালের দাম দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়। মানুষের আয় বাড়ে না, সীমিত আয়ের মানুষ তাই এক ধরনের আত্মগোপনে চলাফেরা করে। সন্তানদের কাছ থেকে আত্মগোপন, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আত্মগোপন, নিজের কাছেও আত্মগোপন।
কার কাছে বলবে মানুষ তার আর্তনাদের কথা? রাজনৈতিক নেতারা ‘বিকল্পহীন’ আত্মপ্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় আচ্ছন্ন। অধিকাংশ সংসদীয় এলাকা পারিবারিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীন, দাদা-পরদাদা-পুত্র-নাতি-নাতনি-নাতবউ; একইভাবে এলাকার বড় রাজনৈতিক দল দুটির শীর্ষ পদেও অনুরূপ পরম্পরা। পারিবারিক ঘেরাটোপ একালের রাজতন্ত্রের পরিপূরক। টমেটোর দাম ২৫০ টাকা হলে বাণী আসতে পারে– ‘টমেটো খেতে হবে কেন? এর মধ্যে কী আছে?’ একটা ডিমের দাম ১৫ টাকায় পৌঁছালে বড় আসন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘সব সিন্ডিকেটের তামাশা! ডিম খাওয়া বন্ধ করেন। দেখবেন ডিম পচতে শুরু করলে ঠিকই ডিমের দাম কমবে।’ এভাবে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রসঙ্গে শোনা যায় আপ্তধ্বনি– এগুলো খেতে হবে কেন? না খেলে হয় না?
০৩.
বিকল্পহীন নেতৃত্বের অযৌক্তিক আত্মবিশ্বাস তাই মানুষের ন্যূনতম স্বস্তি আর অধিকার নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। অন্যদিকে জীবনযুদ্ধে উদ্বাহু ছুটতে ছুটতে মানুষ একটু সুখের আশায় অপেক্ষা করে আছে– ভোট দিয়ে সে আপন ভাগ্য বদলের চেষ্টা করবে!
নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে দুই দলের যত আন্দোলন, বাহাস– দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ সেভাবে দানা বাঁধে না। হাওরের বুক চিরে তাই মনোহরণকারী রাস্তা বানানোর যজ্ঞ বসে, চিত্তহারী সেই রাস্তা ভয়াল বন্যার কারণ হয়। কক্সবাজার বরাবর সাগর আর পাহাড়ের ভেদরেখায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে রেলগাড়ির লাইন বসে; বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার তোয়াক্কাও থাকে না, এর ফলে সমগ্র পাহাড়ি অঞ্চল বন্যায় বিপন্ন হয়ে ওঠে। যেখানে কেনাকাটার হইহই সাড়ম্বর, সেখানে নেতা-আমলাদের ব্যস্ততা, মনোযোগ– মানুষের স্বস্তি ও ন্যূনতম চাহিদা তাই নেতাদের আগ্রহের তালিকার শেষপ্রান্তে দূর মফস্বলের হারিকেনের আলোর মতো জ্বলে।
পরিস্থিতি বদলের জন্য দৃষ্টিভঙ্গির বদল জরুরি, মানবিক নেতৃত্বই পারে মানবিক সমাজ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে। কিন্তু নেতৃত্ব প্রশ্ন শুনতে অভ্যস্ত নয়, আনুগত্যই এখানে যোগ্যতা হিসেবে গণ্য। ‘আপনার কোনোই বিকল্প নাই’– এই কথা মুহুর্মুহু নেতার কানে গানের মতো বাজতেই থাকে। বিকল্পহীনতার দামামার মাঝে এক ফাঁকে গণতন্ত্রের বহুমতের সৌন্দর্য চিরতরে হারিয়ে যায়!
০৪.
এবং নেতৃত্ববিষয়ক একটি সোভিয়েত গল্প।
কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে স্তালিনের অপকর্মের একটানা ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন ক্রুশ্চেভ। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় ক্রুশ্চেভ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, স্তালিনের হাতে পড়ে দেশের মহাসর্বনাশ ঘটে গেছে!
আচমকা শ্রোতাদের মধ্য থেকে একটি প্রশ্ন ভেসে আসে। ‘আপনি এখন এত কথা বলছেন! কিন্তু তখন আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘যিনি এই প্রশ্নটি করলেন, তিনি অনুগ্রহ করে উঠে দাঁড়াবেন কি?’– গম্ভীর স্বরে ক্রুশ্চেভ হলভর্তি শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
পিনপতন স্তব্ধতা পুরো হলঘরে। প্রচণ্ড ভয়ে ভীত ওই প্রশ্নকারী উঠে দাঁড়ালেন না।
‘আপনি এখন যেখানে, আমিও তখন ঠিক সেখানেই ছিলাম।’ ক্রুশ্চেভ উত্তর দিলেন।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল
mahbubaziz01@gmail.com
মন্তব্য করুন