- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- নানারকম সিন্ডিকেট এবং ‘দায়হীন’ কর্তৃপক্ষ
উচ্চারণের বিপরীতে
নানারকম সিন্ডিকেট এবং ‘দায়হীন’ কর্তৃপক্ষ

বাজারে গিয়াছিলাম। খাসির দামে মুরগি কিনিয়া ঘরে ফিরিলাম– ষাটের দশকে দৈনিক ইত্তেফাকে কলামিস্ট মুসাফির [তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া] দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এই স্মরণীয় উক্তি করেন। ষাট বছর পর সমকালের ৩১ আগস্ট, ২০২৩ তারিখের প্রধান খবরে বলা হচ্ছে, ‘দিন দশেক আগে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবরে বাংলাদেশের বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ে কেজিতে ২০ টাকা। অথচ দেশে বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের ঘরে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। তুলকালাম কাণ্ড ঘটে কাঁচামরিচের বাজারেও। সরবরাহের ঘাটতির অজুহাতে প্রতি কেজি কাঁচামরিচের দাম ১০০ টাকা থেকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে হাজার টাকায় পৌঁছে।’
নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ বরাবরই এ দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। বাজারেই যায় সীমিত আয়ের অধিকাংশ, সেই বাজারদর যে হারে বাড়ে, অন্যদিকে আয় বাড়ে না– তাতে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের দিনযাপন ক্রমাগত আরও গ্লানিকর হয়।
এক কেজি কাঁচামরিচের দাম এক হাজার টাকা! আর ডিমের দাম নিয়ে বাজারে যা চলছে, তাকে সংক্ষেপে ‘লঙ্কাকাণ্ড’ বললেও কম বলা হবে। চিনি, রসুন, রুইমাছ, গরুর মাংস– কোনটার চেয়ে কোনটার দাম বাড়ার হার বেশি, তা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। তবে বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ যে তাদের খেয়ালখুশিমতো পণ্যের দাম বাড়ায়, তা খালি চোখেই ধরা পড়ে। বৃহদাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জোট বেঁধে পণ্যের দাম বাড়ায়, কখনও এক রাতের মধ্যে– যেমন, পেঁয়াজ প্রতি কেজিতে ২০-৩০ টাকা বাড়িয়ে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে হতবুদ্ধি করে তোলে। আমরা জানি, এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ, দেশের মানুষকে এক বছর হলো আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো [বিবিএস] এই হিসাব দিয়েছে। এর মধ্যে বাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজি পুরো পরিস্থিতি অসহনীয় করে তুলেছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? নিশ্চয়ই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান দায়িত্ব। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গত ২৬ জুন বাজার সিন্ডিকেট বিষয়ে সংসদে বলেন, ‘বড় গ্রুপগুলোকে জেল-জরিমানা করা যায়; কিন্তু তাতে হঠাৎ যে সংকট তৈরি হবে, তা সইতে কষ্ট হবে। তাই আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়।’ বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘শুধু জেল-জরিমানা ও পুলিশ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সমাধান নয়।’
২.
বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে দায়িত্বশীলদের যে সহনশীল মনোভাব, ডেঙ্গু সৃষ্টিকারী মশককুলকে নিয়েও একই রকম সহনশীল মনোভাব দেখা যাচ্ছে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের। বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট সমকালের প্রথম পাতার আরেকটি সংবাদ শরীর-মন অবশ করে দেয়। ‘রাউফ-রাইদা যে ঘরে নেই সেখানে থাকব না’ শিরোনামের মর্মন্তুদ সংবাদে আমরা জানতে পারি, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৮ আগস্ট মারা যায় মো. ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতির পুত্র ৯ বছরের আরাফাত হোসেন রাউফ। সাত দিনের মাথায় ২৫ আগস্ট মারা যায় রাউফের বোন ৭ বছরের ইসনাত জাহান রাইদা। মিরপুরের পাইকপাড়ার বাসার অদূরে আইকন একাডেমির কেজি ক্লাসের ছাত্র রাউফ; একই স্কুলে নার্সারিতে পড়ত রাইদা। ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় মিরপুরের ডেল্টা হাসপাতালে রাউফকে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। যে রাতে রাউফ মারা যায়, সে রাতেই বোন রাইদার জ্বর আসে। পরদিন ডেঙ্গু পরীক্ষায় পজিটিভ এলে ডেল্টা ও ইবনে সিনা হাসপাতাল ঘুরে সিট না পেয়ে দালালের মাধ্যমে রাইদাকে ১৯ আগস্ট ধানমন্ডির রেনেসাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুত্রকে বাসায় রেখে চিকিৎসা করিয়েছিলেন; তাকে হারিয়েছেন– কন্যার ক্ষেত্রে মরিয়া হয়ে ওঠেন ইব্রাহিম ও রাবেয়া। ইব্রাহিমের অভিযোগ, রেনেসাঁ হাসপাতালে পাঁচ দিনে তাঁর কন্যার সঠিক চিকিৎসা হয়নি। মেয়ে ভালো হয়ে গেছে জানিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২৪ আগস্ট রাইদাকে ছেড়ে দিলেও বাসায় ফেরার পর তার অবস্থা আরও খারাপ হয়। তাকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন রাইদা মারা যায়।
কী বলা যায় এই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে? ৯ ও ৭ বছরের দুটি শিশু মশার কামড়ে মরে যাবে এই দেশে; মরে যাবে একের পর এক অপাপবিদ্ধ শিশু; কেউ নেই দেখবার? কোনো কথা বলবার? মধ্য পাইকপাড়ায় যে বাসায় রাউফ-রাইদা বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত, গত এক মাসে সেখানে আরও ছয়জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ২০-২৫ দিন আগে শিশু দুটির পিতা ইব্রাহিমও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। কী বলবার আছে সিটি করপোরেশনের? কী করছে কর্তৃপক্ষ? স্কুলে স্কুলে শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, শিক্ষয়িত্রী ও শিক্ষক মারা গেছেন, মারা যাচ্ছে মা– ভেঙে যাচ্ছে সাজানো সংসার; ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে– কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় হতে হয় না। নির্বিবাদে আমরা শিশুদের ঠেলে দিচ্ছি মৃত্যুদূত মশককুলের সামনে, প্রতি আগস্টে ডেঙ্গু জোর থেকে আরও জোরদার হচ্ছে, আমরা কি প্রস্তুতি নিই? নিয়েছি? এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার সব রেকর্ড ভেঙেছে, নির্বিকারত্বের রেকর্ডও আমরা ভেঙে চলেছি।
কোনো নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিন, কোনো সতর্কবার্তা, কোনো জবাবদিহি চোখে পড়ে না। কী প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার বাহাদুর? সিটি করপোরেশন? স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, মাত্র ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে এর বেশি প্রতিরোধ তিনি করতে পারবেন না। সিটি করপোরেশন জানাল, যে কীটনাশক তারা এনেছে, তাতে ভেজাল আছে। তারা একটি স্বাস্থ্য নির্দেশিকা ছাপানোর উদ্যোগ নিল। যখন মশাকে দিনরাতের চেষ্টায় সমূলে বিনাশ করতে হবে, তখন স্বাস্থ্য নির্দেশিকা ছাপিয়ে মশা মারার উপকারিতা বোঝানো যে কত বড় তামাশা– সেটা বুঝবার মতো মানসিকতাও কর্তৃপক্ষ হারিয়ে বসেছে। অতি ক্ষুদ্রাকৃতির ডেঙ্গু মশার অবারিত বিস্তার এ দেশের কর্তৃপক্ষের দায়হীনতার বড় এক উদাহরণ হয়ে দেখা দিল।
৩.
আসলে এ দেশে মৃত্যুর দামই বোধ হয় এখন সবচেয়ে সস্তা। হাইওয়েতে গাড়ি চলতে চলতে ধানক্ষেতে উবু হয়ে উল্টে পড়ছে; নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভারের খণ্ডাংশ পড়ে যাচ্ছে চলন্ত গাড়ির ওপর; বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া নালায় পড়ে দুই দিন পর ভেসে আসছে শিশুর লাশ; মাইক্রোবাস থেঁতলে দিচ্ছে উল্টো দিক থেকে আসা ট্রাক; ট্রেন চূর্ণ করছে পুলিশের লরি। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব অপমৃত্যু নিশ্চিত করে। যার যেখানে দায়িত্ব সেখানে দায় নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায়, কখনও কাউকে দায় নিতে দেখা যায় না।
৪.
এবং কর্তৃপক্ষের দায়হীনতা নিয়ে একটি বিদেশি গল্প
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়েই আবিষ্কার করলেন, তাঁর দেশ ভারতের বহু গোপন দলিলপত্রের ফটোকপি পাকিস্তানে চোরাচালান হয়ে গেছে। তিনি এ ব্যাপারে সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের নিয়ে জরুরি সভায় বসলেন। রাজীব গান্ধী জানতে চাইলেন, পাকিস্তানিদের হাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন্ দলিলটির কপি গেছে?
প্রতিরক্ষা সচিব জানালেন, ভারতের ট্যাঙ্ক, প্লেন, গোলাগুলির গুদাম ইত্যাদি সবকিছুর ম্যাপই এখন পাকিস্তানিদের হাতে!
মহা বিপদের কথা!– রাজীব তখনই আদেশ দিলেন, যে করেই হোক ভারতীয় গুপ্তচরদের অনুরূপ ম্যাপ পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসতে হবে!
ভারতীয় গোয়েন্দারা ছড়িয়ে পড়ল ইসলামাবাদে। ক’দিন পরই তারা ম্যাপ হাতে ফিরে এলো। রাজীব আবার তলব করলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। টেবিলের ওপর ম্যাপ রেখে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেটা দেখতে।
‘এ কী! ট্যাঙ্ক, প্লেন, গোলাগুলি কোথায় সব? কোনোকিছুই যে দেখতে পাচ্ছি না!’ রাজীবের বিস্মিত কণ্ঠ।
‘ওগুলোর কিছুই আর ওদের নেই।’ বলতে থাকলেন প্রতিরক্ষা সচিব, ‘আপনাকে দেবার আগে এই ম্যাপ আমি দেখেছি। এখানে যা দেখতে পাচ্ছেন, তা হলো ওদের সামরিক অফিসারদের বড় বড় প্লটের ম্যাপ। পাকিস্তানে আজকাল ক্যান্টনমেন্ট ও তার আশপাশে মিলিটারি স্থাপনার পরিবর্তে অফিসাররা নিজেদের বাড়ি বানাতেই ব্যস্ত। এটা ওদের জমি আর বাড়ির ম্যাপ।’
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
মন্তব্য করুন