দশদিক
মধ্যবিত্তের দিন কি শেষ?

ফারুক ওয়াসিফ
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে সুনামধারী চরিত্রটি বেশ কিছুদিন হলো নিখোঁজ। জাতীয় নাটকে তিনি কখনও বিবেক, কখনও সংগ্রামী নেতা, আবার কখনও কান্নাজাগানিয়া চরিত্র ধারণ করতেন। কিন্তু এখন তিনি যেন দর্শক। এই ‘তিনি’ হলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বলা হয়, আমাদের মতো দেশে গণতন্ত্র আর মধ্যবিত্ত ছিল দু’জনে দু’জনার। এমনকি শিক্ষা, প্রগতি, সংস্কৃতি ও রুচির বড়াই এই শ্রেণির মানুষদেরই মানাত। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলও মনে করতেন, মধ্যবিত্তরাই ধনীদের কাছে গরিবদের হয়ে দেনদরবার করবে; তারাই হবে গণতন্ত্রের বাহন।
কিন্তু আমাদের নিকটকালের ইতিহাস দেখাচ্ছে ভিন্ন ইশারা। সাবেক সোভিয়েত ব্লক থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশ অবধি ঘটনা হলো এই, মধ্যবিত্ত শ্রেণি কর্তৃত্ববাদেই বেশি আরাম পাচ্ছে। রাশিয়া থেকে বেলারুশ, পোল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরি এবং ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বড় অংশটাই বিভিন্ন রঙের কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমর্থক হয়ে বসে আছে। ভোটের মাধ্যমে অথবা বিনাভোটে তারা যতটা না গণতন্ত্রের সমর্থক; তার চেয়ে বেশি মজে আছে উন্নয়ন নামক অর্থকরী মধুতে। অথচ জন্মকালে এই শ্রেণিটাই বিপ্লব করেছে (রাশিয়ায়); স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে (দক্ষিণ এশিয়ায়)। আমাদের ষাটের দশকের সংগ্রামী গৌরবের গল্পের সোনালি চরিত্র তো মধ্যবিত্ত থেকে আসা রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরাই।
এক লোক খুব করে দেশের ভালো চাইছিলেন। দিনরাত কেবল একই চিন্তা– কী করে দেশের ভালো হবে। তো, এক দরবেশ এক রাতে তাঁর স্বপ্নে দেখা দিলেন। বললেন, ‘তোমার আবেগ দেখে আমি খুশি। বলো, কী চাও?’ লোকটা আর কী বলবে! বললে, ‘হে দয়াল দরবেশ, আমি চাই আমার দেশে এমন রাজনীতি চলুক, যা গণতান্ত্রিকও হবে আবার উন্নয়নও করবে।’ কথা শুনে দরবেশের কপালে চিন্তার রেখা ফুটল। একটু ভেবে নিয়ে তিনি বললেন, ‘সব কি আর আমি পারি রে! যা বর দিলাম, তোদের দেশে এমনটাই হবে কিন্তু ওই দুটি জিনিস একসঙ্গে কখনও পাবি না।’ গণতন্ত্র থাকলে উন্নয়ন পাবি না, উন্নয়ন চাইলে গণতন্ত্র হারাতে হবে।
মধ্যবিত্ত উন্নয়নকেই বেছে নিল। তার উত্থানের গল্পটা বদলে গেল লাগাতার অবক্ষয়ের করুণ কঠিন ট্র্যাজেডিতে।
এর স্পষ্ট কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্রিন রোজেনফিল্ড এ বিষয়ে একটা বই লিখেছেন। বইটার নাম ‘দি অটোক্রেটিক মিডল ক্লাস; হাউ স্টেট ডিপেন্ডেন্সি রিডিউসেস দ্য ডিমান্ড ফর ডেমোক্রেসি’। অর্থাৎ স্বৈরপন্থি মধ্যবিত্তের রাষ্ট্রনির্ভরতা কীভাবে তাদের কাছে গণতন্ত্রের চাহিদা কমিয়ে দেয়। আমাদের মতো দেশে সরকারই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী, কর্মসংস্থানকারী, সুবিধা দানকারী কর্তৃপক্ষ। অল্প বয়স থেকেই বিসিএস পাওয়ার জন্য শুরু হয় সংগ্রাম। সরকারি চাকরি এখন যোগ্যতার চাইতে সুযোগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আর কোনো দিকে তাকানোর উপায় নেই; যদি সরকার বেজার হয়! ওদিকে বেসরকারি খাত অস্থিতিশীল; স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। সুতরাং সরকারি চাকরি হয়ে দাঁড়ায় তরুণদের স্বপ্নের চাঁদ। সেটা হাতে পেলেই কেল্লা ফতে। সব মুশকিল আসান। তার ওপর যখন সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সুবিধা, দায়মুক্তি এবং রাজকীয় সম্মান দেওয়া হয়, তখন তাদের সঙ্গে জনগণের বিচ্ছেদ ঘটে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনগণের চাওয়া আর তাদের পাওয়ার মধ্যে ঘটে যায় বিস্তর ফারাক।
শুধু কি চাকরি? ব্যাংক ঋণ, ঠিকাদারি, এনজিও তহবিল– সব সরকারের হাতে। সরকারের উন্নয়নযজ্ঞে খরচ হওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ছিটেফোঁটা বিভিন্ন রকমের সেবা খাতে কাজ করা, গণমাধ্যমে কাজ করা মধ্যবিত্তের হাতে কিংবা পাতে এসে পড়ে। সুতরাং নুন খাই যার, গুণ গাই তার।
এভাবে রাষ্ট্রনির্ভর হতে হতে, সরকারমুখী থাকতে থাকতে মধ্যবিত্ত একদিন দেখতে পায়, তার কোনো জায়গা নেই। যদি গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে জনমতেরও দাম থাকে না। ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বুদ্ধিজীবীরাই জনমত গঠন করতেন। তারাই ক্ষমতাকামী দলের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগসূত্র, ক্ষমতার সঙ্গে জনতার রাজনৈতিক ঘটকালি করিয়ে দিতেন। তারাই ভোট এনে দিতেন। কিন্তু যদি ভোটের বালাই আর না থাকে, তাহলে জনমত এবং বুদ্ধিজীবিতার আর দাম থাকে না। ক্ষমতা ধরে রাখা যদি বল প্রয়োগের ব্যাপার হয়, তাহলে আর জনসমর্থনে কাজ কী! তাই দেখা যায়, আগে নেতানেত্রীরা বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনতেন; এখন বুদ্ধিজীবীরাই প্রতাপশালী নেতানেত্রীর বয়ানের দিকে তাকিয়ে কলম ধরেন, কি-বোর্ডে ঝড় তোলেন। ক্ষমতামুখী কম্পাস এখন বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশের হাতে।
এর মধ্যে ঘটনা আরও অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ এক ধরনের অর্থনীতি কায়েম হয়েছে। একে বলা হচ্ছে অপরাধমূলক রাজনৈতিক অর্থনীতি। রাজনীতির অপরাধীকরণ হলে অর্থনীতিরও অপরাধীকরণ ঠেকিয়ে রাখা যায় না। যুক্তরাজ্যের ইউসিএল প্রেস থেকে ‘দ্য ওয়াইল্ড ইস্ট: ক্রিমিনাল পলিটিক্যাল ইকোনমিজ ইন সাউথ এশিয়া’ বইয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এই গল্পটা বলা হয়েছে। বাংলায় বললে বইটার নাম দাঁড়ায়, ‘বুনো পূর্ব: দক্ষিণ এশিয়ার অপরাধমূলক রাজনৈতিক অর্থনীতিগুলো’। সহজ ভাষায় রাজনৈতিক ঠগিতন্ত্রের অর্থনীতি। আমেরিকার বুনো পশ্চিমের মতো এটা হলো এশিয়ার বুনো পূর্ব। আমেরিকায় চলত সোনার দখল বা খনির দখল নিয়ে বন্দুকবাজি। আমাদের এখানে চলে টাকা বানানোর ঠগবাজি, ব্যাংক দখল ও লুণ্ঠনের ভেলকিবাজি; বিশাল বিশাল ভূমির মালিক হওয়ার কারসাজি।
এই ঠগিতন্ত্র কেবল বাংলাদেশের ব্যাপার না। দক্ষিণ এশিয়ার বেশ ক’টি দেশ এই পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে। ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও দুর্বৃত্ত অর্থনীতিতে উত্থান ঘটেছে ‘লিজেন্ড’, ‘গডফাদার’, ‘বড় ভাই’, ‘বস’, ‘দাবাং’ চরিত্রের। বসবাসের অযোগ্য, চরম বৈষম্যপূর্ণ, নোংরা ও অপরাধে ভরা নগরগুলোতে এরা গড়ে তোলে নিজস্ব স্বর্গ, নিজস্ব বাহিনী আর রাজত্ব। জমায় মজা ও মানিকে (অর্থ) একাকার করে ফেলার ওস্তাদি। গত এক দশকে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর বাংলাদেশে ঘটেছে, তার অপরাধজগতের আলো-আঁধারিতে এদের বিচরণ।
এসব চালাতে হলে থাকতে হয় আইনের ঊর্ধ্বে। আইনের লোকজনের সঙ্গে খাতির ছাড়া সেটা অসম্ভব। এরা রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কলকবজা। রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের অপরাধীকরণের এজেন্ট এরা।
এদের হাতেই ঘটেছে সাবেকি মধ্যবিত্তের পরাজয়। মধ্যবিত্তরা সমাজের নেতা নন, চিন্তার দিশারি নন, গণতন্ত্রের পাহারাদার নন। এই পরাস্ত ও দুর্বল মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তখন টিকে থাকার জন্য আরও বেশি করে কর্তৃত্ববাদের সমর্থক হতে হয়।
তখন একদিন মধ্যবিত্তের সেই স্বপ্নবাজ দেশপ্রেমিক মানুষটি ঘুম ভেঙে দেখেন, দেশটায় খুব উন্নয়ন হচ্ছে, বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে, পাতাল থেকে আকাশ অবধি পৌঁছে যাচ্ছে উন্নয়ন। কিন্তু গণতন্ত্র ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। তারপর দেখা গেল, উন্নয়ন খাওয়া যায় না। অথচ খাদ্যের ভীষণ দাম। ওষুধের ভীষণ দাম। চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফতুর হতে হচ্ছে মধ্যবিত্তকে। খরচে কুলানো যাচ্ছে না। নিম্নবিত্তের হাহাকার তো কোনো সাউন্ড সিস্টেমে ধরাই পড়ল না। তাদের গল্পটা যারা বলবে, সেই মধ্যবিত্ত নিজেই এখন কাবু, ছত্রভঙ্গ, শক্তিহীন। কারণ গণতন্ত্র ও গণের বাক্স্বাধীনতা একদম নিভু নিভু।
মধ্যবিত্ত নিজের ইমেজ হারিয়ে ফেলেছে। নিজের ছবিটাই তার কাছে আর স্পষ্ট না। জনগণের সামনে যে সুবোধ ইমেজ এতদিন দাঁড় করানো ছিল; যে মহিমা তারা, মানে আমরা উপভোগ করতাম, তা তলানিতে নেমে গেছে। তারপরও আমাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। অর্থনীতির দুর্বিপাকে রং জ্বলে গেছে মধ্যবিত্তের সেলফ পোর্ট্রেটের। এবার বাস্তবতার দিকে তাকানোর সময় এসেছে।
মধ্যবিত্ত এভাবে গণতন্ত্র ছেড়ে উন্নয়ন ধরতে গিয়ে দেখল, সাবেকি মর্যাদার আসনটি তার আর নেই। কেউ তার কথা শোনে না। তখন তলার শ্রেণি থেকে হিরো আলমরা তাকে টিটকারি করে। অন্যদিকে ওপরতলা থেকে নাজিল হওয়া মহামারি আর আর্থিক দুর্দিন তাকে একাই মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কেউ তার পাশে নেই।
ষাট, সত্তর, নব্বইয়ে মধ্যবিত্ত বিজয়ী হয়েছিল গণতন্ত্রের পথে; অগণতন্ত্রের পথ তার হতে পারে না।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক এবং সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
faruk.wasif0@gmail.com- বিষয় :
- দশদিক
- ফারুক ওয়াসিফ